Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 1:11 pm

ভ্যাট দেয় না ‘মি. বেকার’, অভিযানের পর ব্যাংক হিসাব জব্দ

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারের একজন সাবেক সিনিয়র সচিবের ভ্যাট ফাঁকির একটি ‘অভিযোগ’। অভিযোগের সূত্র ধরেই নেওয়া হয় গোয়েন্দা তথ্য। বাড়ানো হয় গোয়েন্দা নজরদারি। সত্যতা পেয়েই হয় অভিযান। অভিযানে গিয়ে কর্মকর্তাদের চোখ ছানাবড়া। অভিযানে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ভ্যাট ফাঁকির সন্ধান পেয়েছেন কর্মকর্তারা। রাজধানীর অভিজাত মি. বেকার কেক অ্যান্ড পেস্ট্রি শপের ভ্যাট ফাঁকির তথ্য পেয়েছে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

অভিযানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ৩৪টি বিক্রয়কেন্দ্রে ভ্যাটের হিসাবপত্র রাখা হয় না। ক্রেতা থেকে ভ্যাট নিলেও দেওয়া হয় না চালান। ভ্যাট রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয় না। ভ্যাট ফাঁকির অধিক তদন্তের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান এ তথ্য জানিয়েছেন।

ভ্যাট গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব আসিফ জামান। ১৮ অক্টোবর নিজের ফেসবুকে তিনি একটি স্ট্যাটাস দেন। যাতে তিনি উল্লেখ করেন, “অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকর হওয়ার কারণেই হোক বা সুনাগরিক হিসাবে কর্তব্য পালনের লক্ষ্যেই হোক, দেশের ব্যাপারে ভাবি এবং কোনো সরল ইনপুট দেওয়ার প্রয়োজনে সবসময়েই এগিয়ে আসার চেষ্টা করি। আজকের ঘটনাটা এ উদ্দেশ্যেই বয়ান। ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটা উচ্চমানের বেকারির মধ্যে ‘মি. বেকার’ অন্যতম। তাদের পণ্যের মান এবং দাম দুটোই বেশ উঁচু। তবে দামের একটা বড় অংশ ভ্যাট হিসেবে কেটে নেওয়া হয়। ভ্যাটের হার নিয়ে আমার যথেষ্ট আপত্তি থাকলেও নিজেকে এই বলে সান্ত¡না দিই যে, শেষ পর্যন্ত এটা সরকারের ঘরে জমা পড়বে।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন, “মি. বেকারে আমার সপ্তাহান্তে কেনাকাটা করতে যাওয়া হয়। ছোটখাটো কেনাকাটায় কম্পিউটারাইজড রশিদ নিয়ে মাথা ঘামাই না। হঠাৎ একদিন খেয়াল হতে জিজ্ঞেস করলাম মুদ্রিত রশিদ কোথায়। বললেন ‘সার্ভার ডাউন’। মাঝে আরও একদিন তাই বললেন। আজকেও একই বয়ান। চ্যালেঞ্জ করায় একটা কাঁচা রশিদ দিলেন। কিন্তু তাতে ভ্যাটের বিষয় পৃথকভাবে উল্লেখ নেই। উত্তরা ৩নং সেক্টরের ৪নং রোডের এই আউটলেটে দিনে কয়েক লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়। পাকা রশিদ না পাওয়ার কারণে আমি নিশ্চিত নই যে, আমার দেওয়া ভ্যাট সরকারের ঘরে জমা পড়ল কি না। শুধু উত্তরাতেই এদের আরও অনেকগুলো আউটলেট আছে। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, অন্য আউটলেটগুলো পাকা রশিদ দিচ্ছে।”

স্ট্যাটাসে তিনি এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের কাছে প্রতিকার চেয়ে উল্লেখ করেন, ‘আমি জানি না এনবিআর কীভাবে এ বিষয়গুলো মনিটর করে। ভ্যাট নিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে বিতণ্ডার একপর্যায়ে আমি এনবিআরে কমপ্লেন করার হুমকি দিলাম। ম্যানেজার ভীত হয়ে তার ঊর্ধ্বতন কেউ একজনকে ফোন করলে (আমি ওভারহিয়ার করলাম) তিনি বললেন, কাস্টমারকে কিছু একটা বুঝ দিয়ে দাও। আমাদের স্থায়ী ব্যবস্থা করা আছে। কমপ্লেন কিছু আসবে যাবে না। সত্যিই সেলুকাস। বড় বিচিত্র এই দেশ।’

মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জানান, এই অভিযোগের ভিত্তিতে গোয়েন্দা তথ্য নেওয়া হয়। এনবিআর চেয়ারম্যান অভিযোগটি তদন্ত করার জন্য ভ্যাট গোয়েন্দাকে নির্দেশ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০ অক্টোবর ভ্যাট গোয়েন্দার দুটি দল মি. বেকারের টঙ্গী ও গাজীপুরের প্রধান কার্যালয়ে (কারখানা) অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন উপপরিচালক নাজমুন নাহার কায়সার, ফেরদৌসী মাহবুব ও তানভীর আহমেদ। গোয়েন্দা দল ব্যাপক ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পায়। তিনি জানান, অধিকতর তদন্তের জন্য ‘মি. বেকার’-এর ব্যাংক হিসাবের লেনদেনের হিসাব তলব করা হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার) ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর থেকে তথ্য চেয়ে ও হিসাব জব্দ করে টঙ্গীর ঢাকা ব্যাংক, কামারপাড়া শাখা ও সাউথইস্ট ব্যাংকে নোটিস ইস্যু করা হয়েছে।

ড. মইনুল খান জানান, প্রতিষ্ঠানটির রাজধানীতে ২৯টি পেস্ট্রি শপ ও পাঁচটি সুইটমিটের বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। প্রধান কার্যালয়ের ঠিকানায় তাদের কারখানাও অবস্থিত। ভ্যাট গোয়েন্দার দল ২০ অক্টোবর মি. বেকার কেক অ্যান্ড পেস্ট্রি শপ লি., ১৬০/৪৮৫, মোকদাম আলী সরকার রোড, ধোউড়, তুরাগ, ঢাকা এবং মি. বেকার সুইটস, ২/১ কুনিয়া পাচর, তারগাস, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর সদর, গাজীপুর-১৭০৪ নামের প্রতিষ্ঠান দুটির প্রধান কার্যালয় কাম কারখানায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। প্রতিষ্ঠান দুটি ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের কেন্দ্রীয়ভাবে নিবন্ধিত।

তিনি জানান, অভিযানের সময় প্রতিষ্ঠান দুটিতে ভ্যাট আইনের বাধ্যবাধকতা অনুসারে ক্রয় হিসাব পুস্তক ও বিক্রয় হিসাব পুস্তক পাওয়া যায়নি। ভ্যাট আইন অনুযায়ী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই দুটি হিসাব সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পরিদর্শনের সময় ভ্যাট-সংক্রান্ত অন্যান্য দলিলাদি দেখাতে বলা হলে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা দেখাতে পারেননি এবং এগুলো সংরক্ষণ না করার বিষয়ে তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। ভ্যাট গোয়েন্দাদের অভিযানের আশঙ্কায় প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে মালিকপক্ষ নিজস্ব বাণিজ্যিক দলিলাদিও রাখেন না।

এতে ভ্যাট গোয়েন্দা দলের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, নিজস্ব মনগড়া হিসাবের ভিত্তিতে ‘মি. বেকার’ স্থানীয় ভ্যাট সার্কেলে রিটার্ন দাখিল করে আসছে। একইসঙ্গে তারা ভোক্তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ভ্যাট সরকারি কোষাগারে যথাযথভাবে জমা দেননি। অভিযানের একপর্যায়ে গোয়েন্দা দল প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে অবস্থিত অন্য একটি ভবনের বিভিন্ন তলায় ও ছাদে কর্মচারীদের থাকার কক্ষ তল্লাশি করে তাদের পুরোনো কিছু অসংগঠিত তথ্যাদি পাওয়া যায়। পরে তা জব্দ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এমনকি অভিযানের আগের দিন যেসব পণ্য ফ্যাক্টরি থেকে বের করেছে, তার ভ্যাট চালান (মূসক-৬.৫) দেখতে চাইলেও তারা দেখাতে পারেননি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান দুটি কেন্দ্রীয় নিবন্ধিত হওয়ায় মূসক-৬.৫-এর মাধ্যমে পণ্য ফ্যাক্টরি থেকে আউটলেটে নেওয়ার বিধান থাকলেও তা পরিপালন করা হয় না। পাশাপাশি ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরের আরেকটি দল উত্তরার ৩নং সেক্টরের ৪নং রোডে অবস্থিত মি. বেকার কেক অ্যান্ড পেস্ট্রি শপের ওই বিক্রয়কেন্দ্রটি পরিদর্শন করেন। কর্মকর্তারা প্রথমে পরিচয় গোপন করে পণ্য ক্রয় করে দেখতে পান যে, এই বিক্রয়কেন্দ্রটি মূসক চালান ব্যতীত পণ্য বিক্রি করছে। এখানে তারা অভিযোগকারী অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিবের অভিযোগের সত্যতা পান।

একইসঙ্গে গোয়েন্দা দল ২১ অক্টোবর বেইলি রোডে ‘মি. বেকার’-এর দুটি বিক্রয়কেন্দ্র থেকে পণ্য ক্রয় করেও দেখতে পায় যে, তারা মূসক চালান ব্যতীত পণ্য সরবরাহ করছে। এতে প্রমাণিত হয়, ভ্যাট আইন অনুসারে রেকর্ডপত্র সংরক্ষণ না করে এবং ভ্যাট আইন লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানটি ৩৪টি বিক্রয়কেন্দ্রে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছে।

প্রতিষ্ঠানের কারখানা ও বিক্রয়কেন্দ্রে ভ্যাট চালান ব্যতীত পণ্য সরবরাহ ও বিক্রয় করায় ‘মি. বেকার’কে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করে আজ (গতকাল) প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব সাময়িকভাবে অপরিচালনযোগ্য (জব্দ) করা হয়েছে। অভিযানে জব্দকৃত দলিলাদি ও ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত দলিলাদির ভিত্তিতে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ নির্ণয় ও অন্যান্য আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। একইসঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিযুক্ত ‘মি. বেকার’-এর যাবতীয় উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রয় সরাসরি তত্ত্বাবধান করার জন্য ঢাকা উত্তর কমিশনারেটের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে।