মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ : বহুল আলোচিত ১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির আসামিদের খালাস দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। এসব আসামিকে একের পর এক আত্মসমর্পণের নির্দেশনা দিচ্ছেন উচ্চ আদালত। সম্প্রতি দুই দফায় অভিযুক্ত ১১ জনকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও আত্মসমর্পণের পর তাদের জামিনের বিষয়টি বিবেচনা করতে বলা হয়েছে, তবে অভিযুক্তদের অধিকাংশই এখনও পুঁজিবাজারের সঙ্গে থেকেই বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন।
অভিযুক্তরা হলেন চিটাগাং সিমেন্ট (বর্তমানে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট) মামলায় রকিবুর রহমান, টি কে গ্রুপের মালিক আবু তৈয়ব (প্রয়াত) এবং বুলবুল সিকিউরিটিজ হাউজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম শাহিদুল হক বুলবুল।
অন্যদিকে এইচএমএমএস ফাইন্যান্সিয়াল কনসালটেন্সি অ্যান্ড সিকিউরিটিজের শেয়ার কেলেঙ্কারির মামলায় আসামিরা হলেনÑডিবিএর সভাপতি মোস্তাক আহমেদ সাদেক, ডিএসইর সাবেক চেয়ারম্যান হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ মাহবুব মুর্শেদ, ডিএসইর পরিচালক শরিফ আতাউর রহমান ও আহমেদ ইকবাল হাসান। আর সিকিউরিটিজ কনসালটেন্টস লিমিটেডের শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলায় আসামিরা হলেন এম জে আজম চৌধুরী, শহীদুল্লাহ ও প্রফেসর মাহবুব আহমেদ। এছাড়া এই দুই মামলায় এইচএমএমএস ফাইন্যান্সিয়াল কনসালটেন্সি অ্যান্ড সিকিউরিটিজ ও সিকিউরিটিজ কনসালটেন্টস লিমিটেডও আসামি।
সম্প্রতি ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় চিটাগাং সিমেন্ট মামলায় আলোচিত রকিবুর রহমান, শাহিদুল হক বুলবুল ও আবু তৈয়বকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। এর আগে ২০১৭ সালের ৩০ মে পুঁজিবাজারবিষয়ক ট্রাইবুন্যালের বিচারক আকবর আলী শেখ আসামিদের বেকশুর খালাসের রায় দেন। রায়ে লেখা হয় রকিবুর রহমান ও এএসএম শহিদুল হক বুলবুল সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্দেশনা অমান্য করে চিটাগাং সিমেন্টে পদ ধরে রাখেননি। আর স্টক এক্সচেঞ্জ ছাড়া বিদেশিদের কাছে শেয়ার বিক্রির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। অভিযুক্তরা তাদের আত্মীয়দের কাছে বিপুল পরিমাণ শেয়ার হস্তান্তর করেছেন, এমন অভিযোগও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এছাড়া দুই দশমিক ৯২ কোটি টাকার দুই হাজার ২৪০টি শেয়ার দীর্ঘদিন ফরেন অ্যাকাউন্টে আনসেটেলড অবস্থায় থাকার দায়ভার আসামিদের ওপর বর্তায় না।
সর্বোপরি আসামিরা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ ১৯৬৯-এর ১৭ ধারা লঙ্ঘন করে ১৯৯৬ সালে (জুলাই-ডিসেম্বর) শেয়ার কেনাবেচায় কোনো ধরনের কারসাজিমূলক কাজ করেন নি বলে বিচারক রায়ে লেখেন। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিদের একই অধ্যাদেশের শাস্তিমূলক ২৪ ধারায় শাস্তি দেওয়া যায় না। যে কারণে আসামিদের খালাস দেওয়া হলো বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে ওই তিনজনের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) করা এক আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত সোমবার রুলসহ এ আদেশ দেন।
আদালতে বিএসইসির পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এ এম মাসুম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. খুরশীদুল আলম। তিনি বলেন, চিটাগাং সিমেন্টে মামলায় আবু তৈয়ব এবং এএস শহীদুল হক বুলবুল ও রাকিবুর রহমানকে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। সেইসঙ্গে নি¤œ আদালতের দেওয়া তাদের খালাসের রায় কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে আদালত রুল দিয়েছেন। এ মামলার নথিও হাইকোর্টে তলব করা হয়েছে।
চিটাগাং সিমেন্ট মামলার বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা ১৯৯৬ সালে চিটাগাং সিমেন্টের পরিচালক ছিলেন। ভারতীয় ও ইরানি বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির শেয়ার কিনবেন বলে আসামিরা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ছড়িয়ে শেয়ারমূল্য প্রভাবিত করেন। এ ব্যাপারে পরবর্তীকালে চিটাগাং সিমেন্টের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এরপর কোম্পানির একজন পরিচালক বড় অঙ্কের শেয়ার হস্তান্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে কী পরিমাণ ও কোন ব্যক্তি এ কাজ করেছেন তা ১৯৯৬ সালের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই।
এছাড়া বিএসইসির নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও রকিবুর রহমান এবং এএস শহিদুল হক বুলবুল পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেননি, যা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ অর্ডিন্যান্স ১৯৬৯-এর ১৭ ধারা অনুসারে কারসাজি বলে মনে করে গঠিত তদন্ত কমিটি।
১৯৯৬ সালের শেয়ার কারসাজির ঘটনা উদ্ঘাটনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আমিরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। তিন মাস পর ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ তদন্ত কমিটি সরকারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনে চিটাগাং সিমেন্টের শেয়ার কারসাজির বিষয়টি উঠে আসে। আর এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালের ৪ মে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে মামলা করে বিএসইসি। পরে এই মামলা চলে আসে পুঁজিবাজার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে।
অভিযুক্তদের একজন রকিবুর রহমান। বর্তমানে তিনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। মামলার অপর আসামি শাহিদুল হক বুলবুল নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। মামলার অন্য আসামি আবু তৈয়ব টি কে গ্রুপের মালিক।
জানতে চাইলে শাহিদুল হক বুলবুল বলেন, মামলায় হেরে গেছে বিএসইসি। সেজন্য তারা আপিল করেছে। আমরা হারলে আমরাও আপিল করতাম। এটাকে একটা রুটিনওয়ার্ক বলা যায়। মামলা নিয়ে আমাদের আইনজীবী কাজ করছে। তাদের পরমর্শ অনুযায়ী আমরা কাজ করব।
অন্যদিকে গত সপ্তাহে এইচএমএমএস ফাইন্যান্সিয়াল কনসালটেন্সি অ্যান্ড সিকিউরিটিজ এবং সিকিউরিটিজ কনসালটেন্টস লিমিটেডের মামলার অভিযুক্তদের এক মাসের মধ্যে আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অভিযুক্তরা খালাস পাওয়ার পর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে এ আদেশ দেন আদালত। দুই কোম্পানি এবং কোম্পানির ওই আটজনকে বিচারিক আদালতের দেওয়া খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদনটি করে বিএসইসি।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শফিউল বশর ভাণ্ডারী, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল স্বপন কুমার দাস ও সৈয়দা সাবিনা আহমদ মলি।
এ প্রসঙ্গে শফিউল বশর ভাণ্ডারী বলেন, ‘পুঁজিবাজারের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারক আকবর আলী শেখ গত ১ ফেব্রুয়ারি দুই কোম্পানি এবং তাদের আটজনকে খালাস দেন।’ এর বিরুদ্ধে বিএসইসি ২৫ মার্চ হাইকোর্টে আপিল করেন। আদালত তাদের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেছেন এবং নোটিশ প্রাপ্তির এক মাসের মধ্যে দুই মামলার ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া আত্মসমর্পণের পর তাদের জামিন বিবেচনাও করতে বলেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে এ দুই মামলার নথিও তলব করেছেন।
এ দুই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে মোস্তাক আহমেদ সাদেক বর্তমানে ডিবিএ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। শরিফ আতাউর রহমান ডিএসই পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। আহমেদ ইকবাল হাসান ও শহীদুল্লাহ নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন। সূত্র জানায় এই মামলার অপর আসামি হেমায়েত উদ্দীন আহমেদ বর্তমানে কোনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন। আর এমজে আজম চৌধুরী ও সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।
জানতে চাইলে মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, বিএসইসি হেরে গিয়ে আপিল করেছে। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। আদালত আমাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। এর জন্য আমাদের এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আমরা হাজিরা দেব। এদিকে বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির আইনজীবী এএম মাসুদ বলেন, আসামিদের আত্মসমর্পণের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।