অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

তোফাজ্জল হোসেন: জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ঝুঁকি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। প্রতিবছর এদেশের জাতীয় বাজেটের আয় অন্যতম খাত হিসেবে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সরকারের গ্যারান্টির বিপরীতে অনমনীয় ঋণ নেয়ায় এই ঝুঁকি বেড়েই চলছে। শুধু তাই নয়, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা, ইউরোপকেন্দ্রিক ঋণ জটিলতা ও পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নমনীয় ঋণের উৎসও সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। দেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রকল্পের চাহিদা ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে রাজস্ব আহরণসহ অভ্যন্তরীণ সম্পদের সংগ্রহ হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। তাছাড়া আমাদের জাতীয় বাজেটের একটি নির্ভরশীলতা থাকে বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যের ওপর। আর বাজেটের ঘাটতি পূরণ করতে প্রতিবছরই বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ছয় বছরে দেশে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি।

বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বাড়ায় দেশে এখন ঋণ-রপ্তানি ও ঋণ-চলতি হিসাব অনুপাতেও ব্যাপক উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় বৈদেশিক ঋণের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ পরিহার করে চলা প্রয়োজন। অন্যথায় তা দেশের জন্য বড় বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ানোর শঙ্কা রয়েছে। এখন বাংলাদেশে হু-হু করে ঋণের বোঝা লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলাফল আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথায় ৮৪ হাজার ৭৭০ টাকা ঋণের দায় চাপবে। এছাড়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের নাগরিকদের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২৯২ দশমিক ১১ মার্কিন ডলার বা ২৪ হাজার ৮৩০ টাকা। কারণ বর্তমানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু এই অঙ্কের ঋণ বিদ্যমান রয়েছে, যা গত এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার ৬৬৩ টাকা। আগামী এক বছরে তা আরও কমপক্ষে ১৩ হাজার ৬০ টাকা বাড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে ওই সময়ে মাথাপিছু ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে প্রায় ৯৮ হাজার টাকা। এ কারণে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটেও ব্যয়ের দিক থেকে চার নম্বরে রয়েছে ঋণের সুদ পরিশোধের খাত। অন্যদিকে প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের মাথাপিছু বরাদ্দ ৩৭ হাজার ৩৩৩ টাকা। এ হিসেবে ঋণ মাথাপিছু বরাদ্দের দ্বিগুণেরও বেশি।

অর্থনীতিবিদের ভাষ্যমতে, কর আদায় করতে না পারায় সরকারকে বেশি ঋণের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন উন্নয়ন-সহযোগী দেশ বা সংস্থার সঙ্গে ঋণচুক্তির মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে রয়েছে দুই হাজার ৪৭২ কোটি ৪০ লাখ, এডিবির সঙ্গে রয়েছে এক হাজার ৭৩২ কোটি ৬৭ লাখ ও জাপানের সঙ্গে এক হাজার ৯১৭ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের চুক্তি। এছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে এক হাজার ১৫২ কোটি ৭৩ লাখ, চীনের সঙ্গে ৮০৩ কোটি ৫৫ লাখ, ভারতের সঙ্গে ৭২৭ কোটি ৮৫ লাখ, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ৯৬ কোটি ৯৭ লাখ, আইডিবির সঙ্গে ১০৬ কোটি ২৭ লাখ ও এআইআইবির সঙ্গে ২০৬ কোটি ৯০ লাখ ডলারের চুক্তি রয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে।

সরকার প্রতিবছর দেশীয় উৎস থেকে যেহারে ঋণ নিচ্ছে, তা অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার জন্য নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। কারণ সুদ যে হারে বেড়েছে, তা বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কর আদায়ের হার অত্যন্ত কম। বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় কর আদায় ১০ শতাংশের কম। অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে হলে জিডিপির তুলনায় করের অন্তত ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ থাকা উচিত। করের হার বাড়াতে পারলে ঋণ কমবে। আর উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটানো ভালো পদক্ষেপ নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ। এ হিসেবে প্রতিটি নাগরিকের মাথাপিছু ঋণ ৮৪ হাজার ৭৭০ টাকা। আগামী অর্থবছরে আরও দুই লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা ঋণ নিতে যাচ্ছে সরকার। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ৩২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়া হবে। ফলে ঋণের স্থিতি আরও ১৩ হাজার ৬০ টাকা বাড়বে। এই ঋণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কারণ সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে যে ঋণ নেয়া হয়, তার বিপরীতে সরকারকে বছরে ১০ শতাংশের বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে ৬৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে সরকার, যা দুটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও বেশি। এক্ষেত্রে ঋণ না কমলে এই টাকা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করা যেত।

আমাদের অভ্যন্তরীণ ঋণ অনেক ব্যয়বহুল। সেই ঋণের একটা মোটা অংশ যদি হয় সঞ্চয়পত্র, তাহলে তা আরও ব্যয়বহুল। সরকার ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিচ্ছে, যার অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলোয় সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ভাষ্যমতে, বাজেট মেটাতে অর্থায়নের ৫২ দশমিক আট শতাংশই দেশীয় ঋণ। ঋণনির্ভরতা কমানোর জন্য আমাদের রাজস্ব আয় বাড়ানোর প্রয়োজন। এক্ষেত্রে রাজস্ব খাতে বিভিন্ন সংস্কার জরুরি। সরকার ঠিকমতো ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না বলেই এর দায় নিতে হচ্ছে জনগণকে। তুলনামূলকভাবে বিদেশি ঋণ অনেক সাশ্রয়ী। কিন্তু সরকার সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয় বেশি সুদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে। এতে আর্থিক খাতে চাপ বেড়ে যাচ্ছে। সর্বোপরি ঋণের সুদ পরিশোধে আমাদের বাজেটের একটা বিশাল অংশ চলে যায়। যদিও বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং আইএমএফের ঋণে রয়েছে মোটামুটি সহনীয় সুদ, কিন্তু অন্যান্য সেক্টর থেকে যে ঋণ আসে, বিশেষ করে টাইড লোন অথবা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট, যা আগে কিছু দেশ থেকে এসেছে, তা অনেক উচ্চ সুদের ঋণ। সার্বিকভাবে আমাদের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করতে হবে। তবে ভেবেচিন্তে সেটি গ্রহণ করা উচিত, যেন পরবর্তী প্রজšে§র ওপর বিশাল ঋণের বোঝা না চাপে। আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে। যতটুকু সম্ভব বৈদেশিক ঋণ না নেয়া এবং এর চেয়ে আমাদের যদি ব্যবসা-বাণিজ্য, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়িয়ে এবং বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করতে পারি, সেক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের পরিমাণ কমে আসবে। তখন বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ টেকসই উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারবে।

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০