গতকালের শেয়ার বিজে প্রকাশিত ‘খেলাপি গ্রাহকদের ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো’ শিরোনামের খবরটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে। রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত, বেসরকারি ও বিদেশি তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা এখন ৫৭টি। অথচ আমাদের বাজার যথেষ্ট সীমিত। ফলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে দিন দিন তীব্র হচ্ছে প্রতিযোগিতা। সেখানে টিকে থেকে নিয়মিত লভ্যাংশের ঝুলি বড় করাটা কঠিন। এ অবস্থায় বেসরকারি ব্যাংকগুলো লাভের যে টার্গেট তৈরি করছে, তা একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। যে কারণে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে যেনতেনভাবে; এক ব্যাংকের ঋণখেলাপি অন্য ব্যাংকে গিয়ে হচ্ছেন সমাদৃত। এ দৈনিকে দেশের বৃহৎ এক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঘটনা উল্লেখ করা হয়, যারা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ব্যবসায় বেশ পরিচিতি লাভ করেছে সম্প্রতি। অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটি ভালো ব্যবসা করা সত্ত্বেও ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পর তা পরিশোধ না করার দিক থেকে কুখ্যাত। এরা নাকি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আনুমানিক সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল, যার পুরোটাই খেলাপি। প্রথম কথা, চিহ্নিত খেলাপিদের ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তার পরও কীভাবে তারা ঋণ পেয়ে যাচ্ছেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার। ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের কুফল বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন আমাদের প্রতিনিধির কাছে বলেছেন, ‘খেলাপি ঋণ অর্থনীতির জন্য একটি বিষফোঁড়া। তার ওপর খেলাপি গ্রাহকরা যদি বার বার এভাবে সুযোগ পায়, তা আরও ক্ষতির কারণ হবে।’ এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের সুযোগ কম।
লক্ষণীয়, কয়েক বছর আগে নতুন ব্যাংকগুলো যখন বাজারে আসে, তখনই প্রতিযোগিতার দিক দিয়ে বাজার অসুস্থ হয়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন অনেক বিশেষজ্ঞ। তাদের আরও শঙ্কা ছিল, নতুন ব্যাংকগুলো ব্যবসা করতে পারবে না। দ্বিতীয়টি সত্য হয়নি। কিছু নতুন ব্যাংক এরই মধ্যে রেখেছে প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর। তবে বাজারের প্রতিযোগিতার বিষয়টি নিয়ে এখনও ঢালাওভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। কেননা ঘটনাটি নতুন ব্যাংকগুলো বাজারে আসার কারণে হতে পারে। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাবেও তা ঘটে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু একটি উপাদানকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা ন্যায়সঙ্গত হবে না।
অযৌক্তিক মুনাফা লাভের এমন প্রতিযোগিতা ‘অসুস্থ’ হোক বা না হোক, অস্বীকার করা যাবে না এটি ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাবকেই প্রতিফলিত করে। এই ছোট্ট দেশে বড় ঋণ গ্রাহকদের কেউ অপরিচিত নয়। আবার চিহ্নিত খেলাপি গ্রাহকরাও পরিচিত। তার পরও যে এক ব্যাংকের খেলাপি গ্রাহককে প্রলোভন দেখিয়ে নিজ ব্যাংকের প্রতি টানছেন, তাতে পদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও নৈতিকতার অভাবই প্রতিফলিত। এ অবস্থায় দ্রুত সক্রিয় হতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। দীর্ঘমেয়াদি ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ অর্থনীতির জন্য কোনো সুসংবাদ নয়। তাছাড়া আমাদের অর্থনীতি এরই মধ্যে পুঁজি পুঞ্জীভূতকরণের প্রাথমিক ধাপ অতিক্রম করেছে বলে মনে হয়। ফলে এসব ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া চলবে না। ঋণ দিতে দিতে কোনো ব্যাংক তত্ত্বীয়ভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়লে শেষ পর্যন্ত সমালোচনা গলাধঃকরণের পাশাপাশি তার আর্থিক দায়ভার নিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই। ওই অবস্থা যেন সৃষ্টি না হয়, তার প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার। আরেকটি বিষয়, ব্যাংকগুলো ঋণ দিচ্ছে আমানতকারীর কষ্টার্জিত সঞ্চয় থেকে। তাই ঋণ প্রদানে ব্যাংকের দায়িত্বশীলতাও নিশ্চিত করতে হবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে।