মো. জিল্লুর রহমান: খেজুরের রস ও গুড় পছন্দ করে না, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। এক সময় শীত এলেই মায়ের হাতে বানানো হরেক রকমের পিঠা-পুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যেত। শীত মৌসুম এলে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ বলে খ্যাত ‘খেজুর গাছ’কে ঘিরে জনপদে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করত। শীত মৌসুমে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি গুড় পাটালি, পিঠা, পায়েস প্রভৃতি নিয়ে গ্রামের লোক অতিথিদের আপ্যায়নে চেষ্টা করত। কিন্তু সেই খেজুরের রসের দানা গুড়, ঝোলা গুড়ের ঘ্রাণ এখন আর গ্রামের হাটবাজারে খুব একটা দেখা যায় না। সবাই শীতের ঐতিহ্য মিষ্টি খেজুরের রসের স্বাদ আজ ভুলতে বসেছে। আগের মতো আর বাজারে পাওয়া যায় না সেই আসল খেজুরের পাটালি ও সেই ঘ্রাণ। খেজুরের গুড় হিসাবে যা পাওয়া যায় তার অধিকাংশই এক শ্রেণির মুনাফাখোর চিনি থেকে তৈরি করে বাজারজাত করে। এজন্য অনেকে বলেন, প্রতারণার আরেক নাম খেজুরের গুড়! তবে গ্রামীণ ঐতিহ্য ও অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে খেজুরের রসকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এবং এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও খুলনা জেলা বরাবরই খেজুরগাছ, গুড় ও রসের জন্য বিখ্যাত ছিল। এক সময় অর্থকরী ফসল বলতে খেজুর গুড়ের বেশ কদর ছিল। যশোরের ঐতিহ্যবাহী গুড় পাটালির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। যশোরের খেজুরের রস ও গুড় স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়। সাত আট বছর আগেও শীতকালে এসব এলাকার গাছিরা খেজুর গাছের রস সংগ্রহে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাতেন। তারা খেজুরের রস ও পাটালি গুড় বিক্রি করে বিপুল অঙ্কের টাকা আয় করতেন। বিদেশে রপ্তানি করতেন কিন্তু কালের বিবর্তনে বিগত বছরগুলোতে তা ক্রমশ বিলুপ্ত হতে বসেছে। খেজুর রস দিয়ে শীত মৌসুমে পিঠা ও পায়েস তৈরির প্রচলন থাকলেও শীতকালীন খেজুর গাছের রস এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। এজন্য একসময় তীব্র শীতের মাঝেও খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত থাকতেন গাছিরা। গত কয়েক বছরের ব্যবধানে ক্রমবর্ধমান মানুষের বাড়িঘর নির্মাণ আর নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ক্রমেই খেজুর গাছের সংখ্যা কমে গেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের কিছু কিছু এলাকায় এখনও পর্যাপ্ত পরিমাণ খেজুর গাছ থাকলেও সঠিকভাবে তা পরিচর্যা না করা, নতুন করে গাছের চারা রোপণ না করা এবং গাছ কাটার পদ্ধতিগত ভুলের কারণে প্রতি বছর অসংখ্য খেজুরগাছ মারা যাচ্ছে। এছাড়া এক শ্রেণির অসাধু ইটভাটার ব্যবসায়ীরা জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছ ব্যবহার করার কারণে ক্রমেই কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও শীত পড়ার শুরুতেই পেশাদার খেজুর গাছিরা চরম সংকট মোকাবিলা করছে। তারপরেও কিছু কিছু এলাকায় শখের বশত গাছিরা নামেমাত্র খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ওই গাছিরা সকাল-বিকাল দুই বেলা রস সংগ্রহ করছে। প্রভাতের শিশির ভেজা ঘাস আর ঘণ কুয়াশার চাদর, হেমন্তের শেষে শীতের আগমনের বার্তা জানিয়ে দেয় গাছিদের কর্মতৎপরতা। এক সময় মৌসুমি খেজুর রস দিয়েই গ্রামীণ জনপদে শুরু হতো শীতের আমেজ।
শীতে খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে গাছ কাটে গাছিরা। হেমন্তের শুরুতেই খেজুরগাছ থেকে রস বের করার উপযোগী করে কাটা শুরু হয়। প্রথম গাছ কাটার পর দ্বিতীয়বার চাঁছ দিয়ে সেখানে বসানো হয় কঞ্চির বিশেষভাবে তৈরি নলি বা চোঙ্গা। তার পাশে বাঁশের তৈরি ছোট শলাকা পোঁতা হয় ভাঁড় (কলস) টাঙানোর জন্য। চোখ বেয়ে নলি দিয়ে রস পড়ে ভাঁড়ে। খেজুরগাছ কাটা ও তা থেকে রস বের করার মধ্যেও কিছু কৌশল আছে। যে কেউ ভালো করে গাছ কাটতে কিংবা রস বের করতে পারেন না। কখন, কীভাবে, কোনখানে কেমন করে কাটতে দিতে হবে এবং যার ফলে গাছ মারা যাবে না, অথচ বেশি রস পাওয়া যাবে তা একজন দক্ষ গাছিই ভালোই জানেন। একবার গাছকাটার পর ২-৩ দিন পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হয়। এক সময় মাটির হাঁড়ি খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য ব্যবহƒত হলেও ইদানীং প্লাস্টিকের বোতল বা জার রস সংগ্রহে ব্যবহƒত হয়।
আসলে শীত যত বাড়তে থাকে খেজুর রসের মিষ্টতাও তত বাড়ে। শীতের সঙ্গে রয়েছে খেজুর রসের এক অপূর্ব যোগাযোগ। এ সময় গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ থেকে সুমধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে পুরোদমে শুরু হতো পিঠা, পায়েস ও গুড় পাটালি তৈরির ধুম। গ্রামে গ্রামে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা নলের গুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড় ও পাটালি গুড়ের মিষ্টি গন্ধেই যেন অর্ধভোজন হয়ে যেত। খেজুর রসের পায়েস, রসে ভেজা পিঠাসহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের তো জুড়িই ছিল না।
কিন্তু কালের বিবর্তনে প্রকৃতি থেকে আজ খেজুরের রস একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য খেজুরগাছ আর গুড়ের জন্য একসময় দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল বিখ্যাত ছিল। অনেকে শখের বশে খেজুরগাছকে মধুবৃক্ষ বলে থাকতেন। ওই সময় শীতের মৌসুমে খেজুর রসের নলেন গুড়ের ম-ম গন্ধে ভরে উঠত গ্রামীণ জনপদ। খেজুর রস দিয়ে গৃহবধূদের সুস্বাদু পায়েস, বিভিন্ন ধরনের রসে ভেজানো পিঠা তৈরির ধুম পড়ত। রসনা তৃপ্তিতে খেজুরের নলের গুড়ের পাটালির কোনো জুড়ি ছিল না। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষ শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁপতে কাঁপতে ঠাণ্ডা খেজুর রস না খেলে যেন দিনটাই মাটি হয়ে যেত। কিন্তু ইটভাটার আগ্রাসনের কারণে আগের তুলনায় খেজুর গাছের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া, ইটভাটা কিংবা অন্য পেশায় দৈনিক রোজগার বেশি হওয়ায়, খেজুরের গাছালির সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। অনেকে চিরতরে বাপ-দাদার গাছালি পেশা ছেড়ে দিয়েছে।
ইটভাটায় খেজুর গাছ পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও ইটভাটার মালিকেরা সবকিছু ম্যানেজ করে ধ্বংস করে চলেছে খেজুরগাছ। গত কয়েক বছর ধরে ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে খেজুরগাছকে ব্যবহার করায় বিভিন্ন এলাকা থেকে দ্রুত খেজুরগাছ ফুরিয়ে যেতে শুরু করেছে। ফলে গ্রাম ও শহরের মানুষ এখন খেজুর রসের মজার মজার খাবার অনেকটাই হারাতে বসেছে।
শখের বসত প্রাকৃতিকভাবে জš§ানো খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহকারী গাছিদের মতে, আগের মতো খেজুর গাছ না থাকায় এখন আর সেই রমরমা অবস্থা নেই। ফলে শীতকাল এলেই অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা গ্রামীণ জনপদের খেজুর গাছের কদর বেড়ে যেত। বর্তমানে এসব অঞ্চলে প্রতি হাঁড়ি খেজুর রস এক থেকে দেড়শ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তাও চাহিদার তুলনায় খুবই কম। গাছিরা বলেন, খেজুরগাছ রক্ষায় বন বিভাগের কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ না থাকায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে খেজুরগাছ আর শীতের মৌসুমে খেজুর গাছের রস শুধু আরব্য উপনাস্যের গল্পে পরিণত হতে চলেছে।
ঐতিহ্যবাহী এ খেজুর রসের উৎপাদন বাড়াতে হলে টিকিয়ে রাখতে হবে খেজুর গাছের অস্তিত্ব। আর সে জন্য যথাযথভাবে পরিবেশ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ইটভাটাসহ যেকোনো বৃক্ষ নিধনকারীদের হাত থেকে খেজুরগাছ রক্ষা করতে হবে। অবশ্য সাম্প্রতিককালে কিছু কিছু এলাকায় কৃষি বিভাগ থেকেও কৃষকদের খেজুরগাছ লাগানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বাড়ির আনাচে-কানাচে, রাস্তার পাশের পরিত্যক্ত স্থানে কৃষকেরা পর্যাপ্ত পরিমাণ খেজুরগাছ রোপণ করলে ভবিষ্যৎ প্রজš§কে খেজুরের রস ও গুড়ের চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, যশোর সূত্রে জানা যায়, এ জেলায় মোট খেজুর গাছের সংখ্যা ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৫৫টি এবং এর মধ্যে রস উৎপাদিত হয় এমন খেজুর গাছের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫৫টি। এসব খেজুরগাছ থেকে বছরে ৫ কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ২৫০ লিটার রস উৎপাদিত হয় এবং বছরে ৫২ লাখ ৪৯ হাজার ৩২৫ কেজি গুড় উৎপাদিত হয়, যার বাজার মূল্য একশ কোটি টাকার ওপরে। বর্তমানে যশোর জেলার ৮ উপজেলায় গাছির সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার ২শ জন। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসাবে, দেশে ২০১৮-১৯ বছরে ১ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন খেজুরের রস উৎপাদিত হয়। গড়ে ১০ কেজি খেজুররস দিয়ে তৈরি হয় প্রায় এক কেজি পাটালি বা গুড় এবং এ হিসাবে দেশে পাটালি ও গুড় উৎপাদিত হয় ১৭ হাজার মেট্রিক টন, যার গড় বাজার মূল্য ৩৫০ কোটি টাকার মতো। জানা যায়, দেশে ও বিদেশে খেজুর রস ও এর গুড়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পরিকল্পিত উপায়ে এর উৎপাদন বাড়াতে পারলে গ্রামীণ জনপদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। তাছাড়া, গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারি উদ্যোগে এর বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ করা দরকার। তরুণ উদ্যোক্তাদের যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ ব্যবসায় যুক্ত করতে পারলে দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব।
এক সময় দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশে খেজুরের গুড় রপ্তানি হতো। এজন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশি বেশি খেজুরগাছ রোপণ করা প্রয়োজন এবং গাছালিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খেজুরের রসের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা দরকার। স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা ও কঠোর নজরদারির অভাবে ইটের ভাটায় অবাধে খেজুরগাছসহ ফলবান বৃক্ষ পোড়ানোর কারণে খেজুর বৃক্ষের বিরাট অংশ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় হয়তো খেজুর রসের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। খেজুরের রসের পিঠা পায়েস তখন শুধুই স্মৃতির রোমন্থন হয়ে বেঁচে থাকবে। এজন্য খেজুর গাছ যাতে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে সেজন্য পরিকল্পিত উপায়ে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ গাছের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব, ঐতিহ্য ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে একে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক
zrbbbp@gmail.com