অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মো. জিল্লুর রহমান: বিশ্বায়নের কারণে এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের বিভিন্ন ধরনের আমদানি-রপ্তানি বৈদেশিক বিনিয়োগসহ নানা লেনদেন করতে হয়। যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চিতি থাকা কোনো দেশের একটি বড় অর্থনৈতিক ভিত্তি ও শক্তি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যথেষ্ট থাকলে সেটা একটা স্বস্তির কারণ হয়। তখন আমদানি ব্যয় মেটানো যেমন সহজ হয়, তেমনি বৈদেশিক ঋণের সুদ প্রদান প্রভৃতি কাজেও ব্যবহƒত হয়। পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার মানে হলো দেশটির যথেষ্ট আমদানি সক্ষমতা আছে। অর্থনীতির তত্ত্বেও বলা হয়, একটা দেশের তিন মাসের আমদানির খরচের সমমানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশ্যই থাকতে হয়।

বৈদেশিক মুদ্রার যথেষ্ট সঞ্চয় যদি থাকে, তখন বৈদেশিক ঋণ নেয়ার সময় চিন্তা করতে হয় না এবং সহজে ঋণও পাওয়া যায়। পাশাপাশি অনেক ব্যবসায়ীও বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে। সেটাও বিদেশি মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। যেসব আমদানি করা হয়, সেই আমদানির মূল্য বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। সেটার জন্য যেকোনো দেশের যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় থাকা দরকার। ফলে আমদানি নিয়েও চিন্তা করতে হয় না। বাংলাদেশের মতো দেশে রপ্তানির তুলনায় আমদানি সবসময় বেশি হয়। ফলে এক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেশি থাকা দরকার। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় এলসি খোলার মাধ্যমে আমদানি সম্পাদিত হয়। আমদানির জন্য যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন, তার সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করে আমদানিকারক বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লাভ করে।

অনেকেরই হয়তো জানা আছে যেকোনো দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের  গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগৃহীত আমানত হিসাবে নেয়া মোট অর্থের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। এটাকে বলে রিজার্ভ। কিন্তু এই অর্থ তারা ঋণ বা অন্য কোনো কাজে খরচ করতে পারে না। এটা গ্যারান্টি হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। আর অন্যদিকে রপ্তানি, রেমিট্যান্স, ঋণ বা অন্যান্য উৎস থেকে আসা মোট বৈদেশিক মুদ্রা থেকে আমদানি, ঋণ ও সুদ পরিশোধ, বিদেশে শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি নানা খাতে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দেয়ার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চিত বা জমা থাকে, সেটাই মূলত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ (ঋড়ৎবরমহ ঊীপযধহমব জবংবৎাব)।

মূলত বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা ভাণ্ডার বলতে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বা মুদ্রাবিষয়ক কর্তৃপক্ষের কাছে বৈদেশিক মুদ্রায় গচ্ছিত সম্পদের মজুতকে বোঝায়। এভাবে গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রধানত আমদানি মূল্য এবং বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ প্রভৃতি পরিশোধ করতে ব্যবহƒত হয়। পণ্য ও সেবা রপ্তানি ও বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের স্বদেশে পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স থেকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত গড়ে ওঠে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বৈদেশিক ঋণবাবদ প্রাপ্ত অর্থ এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের অর্থ। সাধারণত শক্তিশালী বা অনমনীয় মুদ্রা (ঐধৎফ পঁৎৎবহপু) যা আন্তর্জাতিক বাজারে সহজে বিনিময়যোগ্য (যেমন মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, ইয়েন প্রভৃতি), সেটিতেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুত গড়ে তোলা হয়। কোনো দেশ স্বীয় দেশেরই কোনো ব্যাংকে বা কোনো বিদেশে অবস্থিত ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সংরক্ষণ করতে পারে। বিশ্বের বেশিরভাগ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত মার্কিন ডলারে সংরক্ষিত। বৈদেশিক মুদ্রাভিত্তিক সম্পদ বলতে বৈদেশিক ব্যাংকের টাকার নোট, বন্ড, ট্রেজারি বিল ও অন্যান্য সরকারি সিকিউরিটি হতে পারে। সোনার মজুতকেও এর আওতায় গণ্য করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎসের মধ্যে আছে রপ্তানি, প্রবাসী আয়, বৈদেশিক বিনিয়োগ, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান প্রভৃতি। কোনো কারণে অতিরিক্ত দেশীয় মুদ্রার প্রয়োজন হলে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে প্রিন্ট করে সরবরাহ করা যায়, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। বৈদেশিক মুদ্রা শ্রম বা রপ্তানির মাধ্যমে আয় করে আনতে হবে, অথবা ঋণ ও অনুদান হিসাবে পেতে পারে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার বড় একটি অংশ আসে রেমিট্যান্স ও গার্মেন্টশিল্প থেকে। অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে প্রবাসী বাংলাদেশি ও গার্মেন্ট কর্মীরা। আর অন্যদিকে ব্যয়ের বড় জায়গা হচ্ছে আমদানি ব্যয়, নানা ধরনের ঋণ ও দায় পরিশোধ এবং দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে কর্মরত ঠিকাদারদের পাওনা পরিশোধেও বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়। এর বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চাঁদা দেয় বাংলাদেশ। রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি লিখিত নির্দেশনা আছে।

বিশ্বব্যাপী কভিড মহামারির কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতি এবং সেইসঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী যে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে, তার ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর মধ্যেই গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আপত্তি জানিয়েছে এবং স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ক্যালকুলেশনে আট বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অতিমূল্যায়ন হয়েছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ হিসাব করার সময় আইএমএফের মডেল বা গাইডলাইন অনুসরণ করছে না। ফলে কিছু সূত্র থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা বা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এরই মধ্যে প্রদানের জন্য অঙ্গীকার (কমিটমেন্ট) করা হয়েছে, সেসব বৈদেশিক মুদ্রাও রিজার্ভ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর এ কারণেই রিজার্ভ ক্যালকুলেশনে এই গরমিল দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও আইএমএফের এই অভিযোগ মেনে নিয়েছে এবং তাদের এই মর্মে আশ্বস্ত করেছে যে এখন থেকে রিজার্ভ ক্যালকুলেশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের মডেল ও গাইডলাইন কঠোরভাবে মেনে চলবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ক্যালকুলেশন নিয়ে আইএমএফের আপত্তি মেনে নেয়ায় একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের রিজার্ভ যে পরিমাণ উল্লেখ করে আসছিল, তা কখনোই প্রকৃত রিজার্ভ ছিল না। যখন রিজার্ভের পরিমাণ ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার বলে দাবি করা হয়েছিল, তখন সত্যিকার অর্থে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার। এখনো যে বলা হচ্ছে, রিজার্ভ কমে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, সেটিও তাহলে ঠিক নয়। প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ ২৮ বিলিয়ন ডলার হবে। এটা একটি কঠিন সংকট! এমনিতেই দেশে ডলারসংকট চরমে। ডলারের বিপরীতে টাকার লাগামহীন অবমূল্যায়ন করে, আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে এবং কৃচ্ছ্রসাধনের মতো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেও ডলার সংকট সামাল দেয়া যাচ্ছে না। এ রকম একটি খারাপ সময়ে দেশের রিজার্ভের অর্থ থেকে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ক্যালকুলেশনে গরমিলের কারণে আট বিলিয়ন ডলার ‘নাই’ হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এতে দেশের রিজার্ভের পরিমাণই যে কমে গেছে, তা-ই নয়, এই ভুলের কারণে দেশে-বিদেশে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণেও সমস্যা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের অর্থ ডলারের পাশাপাশি বিদেশে বিভিন্ন বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ করে রেখেছে। সবচেয়ে বেশি অর্থ রাখা হয়েছে ডলারে। আবার রিজার্ভের অর্থে দেশেও তহবিল গঠন করা হয়েছে। রিজার্ভ থেকে ৭০০ কোটি ডলার দিয়ে গঠন করা হয়েছে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ)। এ ছাড়া রিজার্ভের অর্থে গঠন করা হয়েছে লং টার্ম ফান্ড (এলটিএফ), গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ)। মূলত এগুলো নিয়েই আইএমএফ আপত্তি জানিয়েছে।

অতীতে বহু বছর ধরে বেশিরভাগ দেশে সোনার মজুতকে মূল মুদ্রা মজুত হিসেবে ব্যবহার করা হতো। সোনাকে আদর্শ মজুত সম্পদ হিসেবে গণ্য করা হতো, কেননা অর্থনৈতিক মহামন্দার সময়েও এর মানের কোনো হেরফের ছিল না। কিন্তু ১৯৭১ সালে ব্রেটন-উডস ব্যবস্থার পতনের পর থেকে সোনার দাম অস্বাভাবিকভাবে পড়তে থাকে। এর আগে ১৯৪৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে একটি সম্মেলনে আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রাসমূহকে সোনা অথবা মার্কিন ডলারের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। তখন বিশ্বের সব সোনার অর্ধেক যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন মার্কিন ডলার থেকে সোনায় সম্পদ রূপান্তরের ব্যবস্থা বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে মার্কিন ডলারই বর্তমানের মজুতগুলোয় সবচেয়ে বেশি ব্যবহƒত বৈদেশিক মুদ্রা।

আয়তন নির্বিশেষে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আছে। এই মজুতগুলোর অর্ধেকেরও বেশি অংশ মার্কিন ডলারে রাখা হয়েছে, কারণ এটিই বিশ্ববাজারের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মুদ্রা। এছাড়া ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং, ইউরো ও জাপানি ইয়েন বৈদেশিক মুদ্রা মজুতে ব্যবহƒত মুদ্রাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেকোনো দেশের নিজস্ব মুদ্রার দেনা পরিশোধ ও মুদ্রানীতি প্রভাবিত করতে ব্যবহƒত হয়। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত দেশের অর্থনীতির ঘাত প্রতিরোধ ক্ষমতা ও নমনীয়তা বৃদ্ধি করে। দেশীয় মুদ্রামানের দ্রুত অবমূল্যায়ন ঘটলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ব্যবহার করে বাজারের ঘাত প্রতিরোধ রক্ষা করা হয়। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, এমন মুদ্রাতেই বৈদেশিক মুদ্রা মজুত করা উচিত, যা দেশীয় মুদ্রার সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত নয়, যাতে ঘাত প্রতিরোধ করা সহজ হয়। কিন্তু বর্তমান যুগে এটি করা কঠিন, কেননা বিশ্বের সব মুদ্রা এখন একে অপরের সঙ্গে অনেক বেশি সংযুক্ত। বর্তমানে গণচীনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা মজুত রয়েছে। এর পরিমাণ ৩০ লাখ কোটি মার্কিন ডলার বা তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান। এর বেশিরভাগই মার্কিন ডলারে মজুত আছে।

স্বাধীনতার পর তৎকালীন সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে প্রায় শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করেছিল। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে মজুত স্বর্ণসহ আমাদের সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ২৭ কোটি চার লাখ ডলার। তবে ২০০০ সালের পর থেকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। ২০০১-০২ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৫০ কোটি ডলার এবং ২০০৬-০৭ সালে রিজার্ভ পাঁচ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। তবে ২০১২-১৩ অর্থবছর বাংলাদেশের রিজার্ভের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় বছর। সে বছরই এক বছরের মধ্যে এক লাফে রিজার্ভ পাঁচ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধি পায় এবং সে বছর রিজার্ভ ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৪ সালের পরের সময়কে বলা যায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্বর্ণযুগ। এক বছরের মধ্যেই রিজার্ভ উঠে যায় ২১ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ২০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে। তার পরের বছর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে রিজার্ভ উঠে যায় ২৫ বিলিয়নে এবং তার পরের বছরই বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে উঠে যায়, অর্থাৎ মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের রিজার্ভ বাড়বে ১০ বিলিয়ন ডলার। এরপর ২০১৯-২০ অর্থবছরে রিজার্ভ উন্নীত হয় ৩৬ বিলিয়ন ডলারে। আর কভিডের মধ্যেই ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রিজার্ভ উঠে যায় ৪৮ বিলিয়ন ডলারে। এখন পর্যন্ত এটাই বাংলাদেশের রিজার্ভের সর্বোচ্চ রেকর্ড। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জ্বালানির দামের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ধাক্কা খায় বাংলাদেশও। কমে আসে রিজার্ভ। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ অনুযায়ী, রিজার্ভ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব সম্পদ। মনে রাখতে হবে, যখন বৈদেশিক মুদ্রা আসে, তখন এর বিপরীতে গ্রাহককে (ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান) বাংলাদেশি মুদ্রা তথা টাকা সরবরাহ করতে হয়। সুতরাং প্রবাসী বাংলাদেশি, গার্মেন্ট কর্মী বা কোনো ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মালিকানা দাবির সুযোগ নেই। আগে রিজার্ভ সোনার আকারে রাখার নিয়ম ছিল। গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ব্যবস্থা না থাকায় এখন রূপান্তরযোগ্য নানা বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ সংরক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার একটি বড় অংশ অন্য দেশের নানা ধরনের সরকারি পেপারে বা ঝুঁকিহীন উচ্চ ঋণমানের সার্বভৌম বন্ডে বিনিয়োগ করে। কিছু অংশ দিয়ে স্বর্ণ কিনে রাখে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে আট কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮১০ কোটি টাকা) অর্থ চুরি হয়েছিল। এই ডলারগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট বা ভল্ট থেকে নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশের রিজার্ভ ডলার থেকেই হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে জালিয়াতি করে নেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যূনতম বাজার ঝুঁঁকিতে সর্বোচ্চ স্বল্পমেয়াদি রিটার্ন নিশ্চিত করতে রিজার্ভ-সম্পর্কিত বিনিয়োগের সিদ্ধান্তগুলো সাবধানতার সঙ্গে গ্রহণ করে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংক তার বৈদেশিক মুদ্রাভাণ্ডার সম্পূর্ণ অলসভাবে বসিয়ে রাখেÑএ ধারণা সঠিক নয়।

আসলে বাণিজ্য ভারসাম্য কখনোই বাংলাদেশের অনুকূলে ছিল না। রপ্তানির চেয়ে সব সময়ই আমদানি ব্যয় বেশি। সাধারণত একটি দেশ তার তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ রাখবে, এটাই রীতি আদর্শ মান ধরা হয়। ২০২১ সালের আগস্টে যখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে তখন তা দিয়ে বাংলাদেশের ৯ মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের সক্ষমতা ছিল। বেশি রিজার্ভ মূলত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য ও সক্ষমতা বাড়ায়। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অর্থ প্রত্যাবাসন সহজ হয় এবং নতুন বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ ও আস্থা তৈরি হয়। দেশের ঋণমান নির্ধারণে রিজার্ভের গুরুত্ব আছে। রিজার্ভ ভালো থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিময় হারে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আসলে অলস পড়ে থাকে না। এর নানা ধরনের কার্যকারিতা আছে। অথচ কেউ কেউ মনে করেন, অলস পড়ে আছে বলে রিজার্ভের অর্থ যথেচ্ছ বিনিয়োগ করা প্রয়োজন।

অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরাও আগেই সতর্ক করেছিলেন, বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, একটা বড়সড় রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করবে। বড় সংকটের সময় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কতটা কার্যকর হয়, তার উদাহরণ হচ্ছে ২০০৮-০৯ সময়ের ব্রাজিল ও মেক্সিকো। গবেষণায় দেখা গেছে, ওই সময়ে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্রাজিল ভালো করলেও মেক্সিকো ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ অর্থনীতির ধাক্কা সামাল দেয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ ব্রাজিলের ছিল, কিন্তু মেক্সিকোর ছিল না। ফলে সে সময় ব্রাজিল তার মুদ্রার মূল্যমান ধরে রাখতে পেরেছিল, মেক্সিকোর পরিস্থিতি ছিল উল্টো। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, রিজার্ভ থেকে অর্থ বিনিয়োগের চিন্তা খুবই বাজে ও বিপজ্জনক। সামনে কী ধরনের সংকট আসবে, তা অনেকের স্পষ্ট জানা নেই, সুতরাং এ মুহূর্তে রিজার্ভের যথেচ্ছ ব্যবহার না করে ধরে রাখাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।

কভিড মহামারির সময় ২০২১ সালের আগস্টে যখন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার পৌঁছেছিল, তখন অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। কিন্তু চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের পর থেকে সারাবিশ্বে জ্বালানি তেল ও খাদ্য সরবরাহে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। একইসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও জনবিক্ষোভ অনেকের মধ্যেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। এ কারণে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। বর্তমান ৩৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ অনেকের কাছে এখনও স্বস্তিদায়ক মনে হতে পারে, কিন্তু বিশ্বব্যাপী চলমান ভয়ংকর মূল্যস্ফীতি সংকট ক্রমহ্রাসমান রিজার্ভ সম্পর্কে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করাই স্বাভাবিক। এরই মধ্যে আমদানি নিয়ন্ত্রণের নানা পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। জ্বালানি তেল, এলএনজি, গম, চাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যস্ফীতির যে আগুন লেগেছে, সেটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ না হলে সহজে থামবে না, জাহাজ ভাড়ার উল্লম্ফনও থামবে না। এর সঙ্গে অচিরেই যোগ হতে যাচ্ছে বিশ্বমন্দা। মন্দার কারণে যদি আমাদের পোশাক রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি যদি শ্লথ হয়ে যায়, কিংবা থেমে যায়, তাহলে অর্থনীতি মহাবিপদে পড়বে। অতএব বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারা যেকোনো উপায়ে প্রতিরোধ করাই হবে দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করার অন্যতম বড় হাতিয়ার।

ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক

zrbbbp@gmail.com

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০