নিজস্ব প্রতিবেদক: কভিড সংক্রমণ গত বছরের শেষের দিকে অনেকটাই কমেছে। অর্থনীতি এখন সচল হতে শুরু করলেও কভিড-পূর্ববর্তী অবস্থায় পৌঁছায়নি। ব্যাংক খাত এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। গতকাল এক ওয়েবিনারে এমন মতামত দেন তারা।
কভিড-পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের অবস্থা নিয়ে ‘আফটার দ্য প্যান্ডেমিক অনসøটÑইকোনমি অন স্ট্রং রিকোভারি পাথ’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলেন দেশি-বিদেশি অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত ওয়েবিনারটিতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান।
ওয়েবিনারে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, করোনার অভিঘাতের পরে অর্থনীতি এখন সচল হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে। এখন অর্থনীতিতে প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, আমাদের দেশে কর্মসংস্থান সেভাবে বাড়েনি। মহামারিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। সামাজিক নিরাপত্তার জন্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোর প্রতি বেশি নজর দিতে হবে। জামানতমুক্ত এসএমই ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সানেমের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, করোনার বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রান্তিক পর্যায়ে গ্রামীণ এলাকায় বেশি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি খাত অবদান রেখেছে। এখন আবার নতুন করে ওমিক্রন শুরু হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মহামারি থেকে সামলে ওঠা ব্যক্তিরা। তিনি বলেন, যাতে আবার সমস্যা না হয়, সেদিকে সরকারের খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে স্বনির্ভর বা ব্যক্তিপর্যায়ে একক আয়ের নির্ভরশীলদের কীভাবে গুরুত্ব দেয়া যায়, তা দেখতে হবে। দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় বিদ্যালয়ে খাদ্য সহায়তা দেয়া যেতে পারে। বিশেষ করে যারা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে রয়েছে, তাদের দেখা উচিত।
বিবিএসএর কাছ থেকে তথ্য সহায়তা দরকার। নিয়মিত কিছু তথ্য পাওয়া প্রয়োজন, যাতে আমরা প্রকৃত তথ্য পেয়ে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারে। বিশেষ করে মহামারিতে বৈষম্য বাড়ে, তা যেন আমরা চিহ্নিত করতে পারি।
তৈরি পোশাক খাতের কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, সংক্রমণের সর্বোচ্চ সময়ে করোনা পোশাক খাতের মাঝারি ও ছোট আকারের প্রতিষ্ঠানে আঘাত হেনেছে বেশি। তারা এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি অনেকেই। আবার রপ্তানিকৃত পণ্যের মূল্য দেশে আসেনি, যদিও আমদানি দায় স্থগিত করার সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এতে করে তাদের বিরুদ্ধে ফোর্সড লোন তৈরি হয়েছে। অথচ আমরা করোনার সময়েও কারখানা চালু রাখতে পেরেছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। এজন্য এখন রপ্তানি বেড়েছে।
বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও প্ল্যামি ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার কমে আসা, একই সময়ে ভিয়েতনামে লকডাউনে থাকা, চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্ব, মিয়ানমারের সমস্যা প্রভৃতি কারণে আমাদের অর্থনীতি দ্রুত সচল হয়েছে, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আদেশ বেড়েছে। এটি টেকসই হবে কি না, সে বিষয়ে ভাবতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, আমরা মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে যাই কি না, সন্দেহ হচ্ছে। কোথাও যেন কিছু একটা হচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের পর ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে এই অবস্থায় পড়ে থাকতে হয় কি না, এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে আমার।’ এর কারণ ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী বলেন, ল্যাটিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর বহু দেশ মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে আটকে আছে। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করার জন্য গবেষণা সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
আলোচনার একপর্যায়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্বের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, সামাজিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং একে অন্যের সঙ্গে খোঁচাখুঁচির আর্থিক মূল্য খুঁজে বের করতে গবেষকরা কাজ করতে পারেন। আমি আহ্বান জানাচ্ছি এ কাজে সময় দেয়ার জন্য। সমাজে নানা ধরনের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও খোঁচাখুঁচি রয়েছে। নিশ্চয়ই তার আর্থিক ক্ষতিও আছে।
আলোচকরা বলেন, রপ্তানি বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক হয়েছে। এটি দেশের জন্য ভালো, বিশেষ করে বর্তমান সময়ের জন্য। বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে ব্যাংক খাতে তারল্য প্রবাহের প্রয়োজন। এদিকে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন সরকারের। বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে আইটি খাতের ফ্রিল্যান্সার অন্যতম। অনেক সম্ভাবনাময় খাত রয়েছে। সেগুলোকে চিহ্নিত করে নীতি সহায়তা দিতে হবে। সেক্ষেত্রে কিন্তু বেশকিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। বড় বড় কোম্পানি খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, কিন্তু ছোট ও মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠান পারেনি। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোকে কীভাবে আমরা মূল্যায়ন করি তা দেখতে হবে।
পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন সংস্থার চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার।