নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের অর্থনীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি বর্তমানে বিপৎসীমায় পৌঁছে গেছে। বর্তমানে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ। এত বেশি অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)। তারা বলছে এ বাণিজ্য ঘাটতি যদি এ অবস্থায় আরও তিন থেকে পাঁচ বছর অব্যাহত থাকে, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে চরম বিপর্যয় ঘটবে। আর এ ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি যদি জিডিপির ৪ শতাংশ হয় তাহলে শিগগিরই অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটবে।
রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল পিআরআই আয়োজিত ‘রিয়েলাইজিং ডেভেলপমেন্ট অ্যাসপিরেশন উইথ ডমেস্টিক রিসোর্স মোবিলাইজেশন অ্যাডমিস্ট ম্যাক্রোইকোনমিক চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক আলোচনা সভার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে এ শঙ্কার কথা বলেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার।
তবে তার এই শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘যদি গত অর্থবছরের সঙ্গে এ অর্থবছরের একই সময়ের অর্থনীতির তুলনা করা যায়, তাহলে আমরা অনেক ভালো অবস্থানে আছি। চলতি অর্থবছরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার, যেটা গত অর্থবছরে ছিল ৪ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। তাছাড়া বৈদেশিক বিনিয়োগ গত অর্থবছরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে ছিল ২৫০ মিলিয়ন ডলার, যেটা এ অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩৬০ মিলিয়ন ডলার।’
পিআরআই চেয়ানম্যান বলেন, বাংলাদেশের যে বাণিজ্য ঘাটতি, তার প্রধান কারণ হচ্ছে আমদানি বেশি, রপ্তানি কম। এছাড়া আমাদের অর্থনীতিতে বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ সংকট। তবে এর পেছনে বৈশ্বিক কারণও রয়েছে। তিনি বলেন, হঠাৎ করে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে রিজার্ভের সংকটের কারণে আজকের এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘গত ৫০ বছরে আমাদের অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। তবে আমাদের মানবসম্পদের তেমন উন্নয়ন হয়নি। আমাদের দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ দেশের বাইরে আছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশ বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে না। তার একটা প্রভাব পড়বে রিজার্ভে।
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, সামনের দিনগুলোতে আমাদের তিনটি চ্যালেজ্ঞ রয়েছে। এগুলো হলোÑমূল্যস্ফীতি, বাণিজ্য ঘাটতি ও বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা। এ তিনটি চ্যালেঞ্জকে বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে নানামুখী কাজ করতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি নগদ সহায়তা দিতে হবে। আমদানিজনিত পণ্যের ব্যয় কীভাবে কমানো যায়, সেটির ওপর নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে আমদানি পণ্যের শুল্ক কমাতে হবে। বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আমদানি রপ্তানির ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে। জাইদী সাত্তার বলেন, ‘আমাদের বৈদেশিক ঋণ এখনও স্বস্তির পর্যায়ে আছে। তবে নতুন ঋণ নেয়ার ব্যাপারে আরও সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ বাড়িয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে হবে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি গত অর্থবছরের তুলনায় অনেক ভালো আছে। তবে আমাদের মূল্যস্ফীতি অনেকটা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে আমাদের খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছে। আর সেটা হয়েছে আমদানির কারণে। তাছাড়া শুধু আমাদের নয়, গোটা বিশ্বের মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। তিনি আরও বলেন, আমাদের সরকার কাজ করছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর পাশাপাশি কৃষিজাত পণ্য আমদানি সহজ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা করছে সরকার।’
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বিশেষত রেমিট্যান্স আহরণে প্রণোদনা দেয়ার উদ্দেশ্য হলো প্রবাসীদের সুবিধা দেয়া। এর মাধ্যমে মূলত দেশের একটি জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে ইউনিফাইড বা একক বিনিময় হারের দিকে যেতে হবে।
এ সময় অর্থনীতিবিদ ড. এম এ রাজ্জাক তার প্রবন্ধে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় কর-জিডিপি অনুপাতে বাংলাদেশ সবচেয়ে পিছিয়ে। কিন্তু উন্নত অর্থনীতির দেশের পর্যায়ে যেতে হলে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। বিশেষ করে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ বা রাজস্ব আয় বাড়ানো খুব জরুরি। তিনি আরও বলেন, অষ্টম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় কর আহরণের ক্ষেত্রে আমাদের যে লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে, তা থেকে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। এদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। কারণ কর আহরণ অভ্যন্তরীণ সম্পদের অন্যতম প্রধান উৎস। সেটিকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তব্যে পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা আমাদের সংকট ও চ্যালেঞ্জগুলো জানি। আমার বাড়িঘর রক্ষার দায়িত্ব আমার। বাইরে থেকে ঝড় আসবে, সেটাকে আমাকেই সামলাতে হবে। অর্থনীতিতে একটি ঝড় এসেছে, তবে আমাদের যা করণীয় আমরা তা করতে পারিনি। আমরা ১২ বছরে বিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়নের পর কেন পিছিয়ে যাচ্ছি, সেটিকে আমাদের জানতে হবে, বুজতে হবে। সরকারকেও তা জনগণকে জানাতে হবে কেন আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।