Print Date & Time : 16 June 2025 Monday 9:01 pm

অর্থনীতির অশনিসংকেত খেলাপি ঋণ

বর্তমান বাংলাদেশের অর্থনীতির  সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ। ব্যাংক খাতের এই সমস্যা নানা চেষ্টাতেও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণের শীর্ষস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা; যার পরিমাণ মোট ঋণের ১০.৯% এবং ৯.৪% ঋণ নিয়ে পরবর্তী স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ; যা আমাদের জন্য লজ্জাজনক ব্যাপার। প্রতিটি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংক তার গ্রাহককে কিছু শর্ত প্রদান করে থাকে এবং সেই শর্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য ঋণের অর্থ ব্যাংককে ফেরত দিতে হয়। কিন্তু যখন এই ঋণ বা ঋণের কিস্তি ফেরত পাওয়া যায় না, তখন তাকে খেলাপি ঋণ বলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবমতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয় ৮.১৬%, যা ১ বছর আগে ছিল ৭.৯৩%। ঋণখেলাপির এই লাগামহীন অবস্থা আমাদের অর্থনীতিতে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও সংকট সৃষ্টি করছে। 

ঋণখেলাপির জন্য সাধারণত তারল্য সংকট দেখা দেয়। দেশের ব্যাকংগুলোর কাছে ২০২২ সালের অক্টোবরে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। যার মধ্যে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য অতিরিক্ত তারল্য ছিল মাত্র ১২ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। অথচ এর আগের বছর একই সময়ে অর্থাৎ ২০২১ সালের অক্টোবরে ব্যবহারযোগ্য অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৩৪ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। মূলত খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে ব্যাংকঋণ দিতে পারে না। আর ঋণ না পেলে বিনিয়োগ কমে যায়। ফলে ব্যাংকের মুনাফা হ্রাস পায় এবং কমে যায় অর্থনৈতিক গ্রোথ ও কর্মসংস্থান। এ ছাড়া বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এই ঋণখেলাপি। আমাদের দেশে ঋণখেলাপির জন্য বেশিরভাগ সময় ঋণ গ্রহীতাকে দায় করা হলেও আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা দুর্বলতাও একটি মুখ্য কারণ। আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণদানের ক্ষেত্রে এখনও ওভারড্রাফট পদ্ধতি ব্যবহার করায়, এটি বোঝা কঠিন যে, ঋণের অর্থ কোথায় ব্যবহƒত হচ্ছে। এছাড়া ঋণের ওপর প্রদেয় সুদ গ্রহীতারা নগদে পরিশোধ করে না, এটি ঋণের অর্থের সঙ্গে যোগ হতে থাকে; ফলে একসময় ঋণ বাড়তে বাড়তে বড় অঙ্কে পৌঁছায় এবং তখনই ঋণখেলাপির সৃষ্টি হয়। এই ঋণের সুদ ও কিস্তিকে ঋণখেলাপির একটি প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নেতাদের প্রভাব, বন্ধকি সম্পদ বিক্রয়জনিত সমস্যা, খেলাপিজনিত মামলা নিষ্পত্তিতে সময় নেয়া প্রভৃতি কারণে ঋণখেলাপি ঘটে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করার ক্ষেত্রে আমাদের আর্থিক খাতের সংস্কারস্বরূপ খেলাপি ঋণের প্রতি প্রাধান্য দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানে স্বজনপ্রীতি ও নেতাদের প্রভাবমুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে, ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে এবং কারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি এবং কারা তা নয় সেটি চিহ্নিত করতে হবে। যারা প্রতিকূল পরিবেশের স্বীকার তাদের সহায়তা করে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করতে হবে। নগদে ঋণের সুদ গ্রহণ, যাচাই-বাছাই করে এবং আবর্তন মেয়াদে ঋণ প্রদান করা যেতে পারে। সর্বোপরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং ঋণগ্রহীতা সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এই সমস্যা সমাধানে।

হামিদা রহমান

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়