অর্থনীতির এককেন্দ্রিক নির্ভরশীলতা যখন ডাচ ডিজিজের কারণ

‘ডাচ ডিজিজ’ আধুনিক অর্থনীতির এই পরিভাষা অপেক্ষাকৃত নতুন। সর্বপ্রথম ১৯৭৭ সালে ‘দি ইকোনমিস্ট’ ম্যাগাজিনে ‘ডাচ ডিজিজ’ শব্দযুগলের ব্যবহার হয়। এ ‘ডাচ ডিজিজ’-এর উৎপত্তি নেদারল্যান্ডস থেকে। গত শতাব্দীতে নেদারল্যান্ডস বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পায়। ফলে তারা বিপুল পরিমাণ গ্যাস রপ্তানি শুরু করে এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্যাপক লাভবান হয়। তাদের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আয়ই হয় এই খাত থেকে; যা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু দেশের মোট রপ্তানি আয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় ডাচ মুদ্রার বিনিময় হার মার্কিন মুদ্রা ডলারের বিপরীতে বেড়ে যায়। ফলে নেদারল্যান্ডস তার মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখতে ব্যর্থ হয় এবং উৎপাদন ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের সামঞ্জস্য হারায়। এখান থেকেই মূলত ডাচ ডিজিজ কথাটির উৎপত্তি। মূলত মাত্র একটি প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা (৮০ ভাগ বা তার বেশি)  এবং ভবিষ্যতে ওই পণ্যের পরিমাণ বা মূল্য হ্রাস পেলে যে আর্থিক মন্দার সৃষ্টি হয় তাকে ‘ডাচ ডিজিজ’ বলে।

ডাচ ডিজিজের আরেকটি উদাহরণ হতে পারে ভেনেজুয়েলা। তেল মজুদকারক  ও রপ্তানিকারক এই দেশটিতে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয় বিশ্ব বাজারে তেলের মূল্য হ্রাস দিয়ে। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তেল রপ্তানিতে শীর্ষে থাকা দেশটির অর্থনৈতিক ধস নামে ২০১৪ সাল থেকে যখন বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যমান হ্রাস পায়। সুতরাং, আমরা এটা বলতে পারি, শুধু একটি মাত্র প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা যেমন অর্থনীতিকে সাময়িক চাঙা করতে পারে তেমন বিপদও ডেকে আনতে পারে। আমাদের বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে একটি। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪.৫৭ শতাংশ এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তৈরি পোশাক খাত অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও সম্প্রতি আমেরিকা ও ফ্রান্সের আনা অভিযোগ এক্ষেত্রে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর (ইউএসটিআর) বিজিএমইএ ও বিকেএমিএ’র বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। তাদের ভাষ্যমতে স্টক লটের বেশ কিছু পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আগে উঠলেও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ এসেছে এই প্রথম। ফলে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি কমেছে এক-তৃতীয়াংশ  ও ইউরোপের বাজারে সাড়ে চৌদ্দ শতাংশ। অন্যদিকে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ায় তৈরি পোশাক খাতে বেড়েছে উৎপাদন ব্যয়। আবার আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ হলো রেমিট্যান্স বিপর্যয়। ২০২২-২০২৩  অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৩৫৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার; যা গত বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ কম। উল্লেখ্য, কোনো দেশে কোনো একক উৎসের ওপর ৮০ শতাংশের এর বেশি অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা পরবর্তী সময় ডাচ ডিজিজের কারণ হতে পারে। যেহেতু দেশের মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশ আয় হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। সুতরাং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য হ্রাস ও অভিযোগ দেশের অর্থনীতিতে একটি বড় উদ্বেগের কারণ। তাই দেশের অর্থনীতিকে নিরাপদ ও শক্তিশালী করতে হলে দেশের অর্থনীতির  এককেন্দ্রিক নির্ভরশীলতা কমিয়ে অন্যান্য অর্থনৈতিক খাতের দিকে নজর দেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে বর্তমান বাজার মান অনুযায়ী কৃষি খাতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। কেননা আমাদের দেশ বেশ কিছু কৃষিপণ্য আমদানি করতে হয়। ফলে অর্থের একটি বড় অংশ ব্যয় হয় আমদানি খাতে। তাই যদি কৃষি ক্ষেত্রে যথাযথ বিনিয়োগ ও নজরদারি করা হয় তাহলে এতে উৎপাদন বাড়বে। ফলে আমদানি খরচ অনেকাংশেই হ্রাস পাবে। এছাড়া রপ্তানিতেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তাই অর্থনীতির এককেন্দ্রিক নির্ভরশীলতা কমিয়ে আমাদের কৃষি খাতসহ অন্যান্য খাতগুলোয় বিনিয়োগ ও নজরদারি করা জরুরি। যাতে বাংলাদেশ নেদারল্যান্ডস ও ভেনেজুয়েলার ন্যায় ডাচ ডিজিজের মতো এমন অর্থনৈতিক রোগে আক্রান্ত না হয় এবং দেশের অর্থনীতি সচল ও সমৃদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়।

নুসরাত জাহান বাঁধন

শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০