অর্থনীতির মাথাব্যথার কারণ বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা

নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতীয় গ্রিড ও গ্রিড বহির্ভূত মিলে দেশে বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩০ হাজার ৭৩৮ মেগওয়াট। এর বিপরীতে পিক টাইমে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে। সে হিসাবে উদ্বৃত্ত সক্ষমতার পরিমাণ ১৪ হাজার ২৬১ মেগাওয়াট। এটি মোট উৎপাদন সক্ষমতার ৪৬ দশমিক চার শতাংশ। এই বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। কারণ এই বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতার বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়। এমন পরিস্থিতিতে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি বিধান করে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

রোববার সকালে রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বাজেট বরাদ্দ নিয়ে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বরাদ্দ পর্যালোচনার লক্ষ্যে গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত সংলাপে এ তথ্য জানানো হয়। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘২০২৪-২৫ জাতীয় বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: প্রস্তাবিত পদক্ষেপসমূহ কি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথেষ্ট?’ শীর্ষক সংলাপে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য এ. কে. আজাদ। সম্মাননীয় অতিথি ছিলেন পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. এম তামিম ও ড. শামসুল আলম।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার ২০২৪ সাল নাগাদ বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের যে প্রক্ষেপণ করেছে তা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তিনি বলেন, বর্তমানে যে হারে চাহিদা বাড়ছে তাতে ২০৩০ সালে দেশে বিদ্যুতের মোট চাহিদা দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৩৭৭ মেগাওয়াট। এর সঙ্গে যদি ২৫ শতাংশ রিজার্ভ উৎপাদন সক্ষমতা যোগ করা হয় তাহলে সেটি দাঁড়ায় ২৩ হাজার ২৫২ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে বর্তমানে ৩০ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। কাজেই এই মুহূর্তে নতুন করে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো যুক্তি নেই।

তিনি আরও বলেন, সরকার ২০৪০ সাল নাগাদ ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। কিন্তু ওই সময়ে দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়াবে ৩৫ হাজার মেগাওয়াট। আর এই বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা অর্জনের জন্য সরকার অধিক মাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে রূপান্তরে সরকারের নীতির পরিপন্থি।

অনুষ্ঠানে এ. কে. আজাদ বলেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাসের কথা বলে দাম বাড়ানো হলো, কিন্তু লোডশেডিং কমেনি। ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ডিজেল দিয়ে সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস এনে কারখানা চালাতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে গেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হচ্ছে।

নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ না থাকায় বিদেশি বিনিয়োগ আসছে নাÑজানিয়ে তিনি বলেন, দেশে প্রায় ২৫ শতাংশ ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২২ শতাংশ। পাশের দেশ ভারতের বিনিয়োগ নীতির কথা তুলে ধরে এ. কে. আজাদ বলেন, তাদের জমি, বিদ্যুৎ, জ্বালানিতে ভর্তুকি দেয়া হয়, ৫ বছরের জন্য কর্মীদের বেতন দেয় সরকার। বিনিয়োগ তো ওই দেশেই হবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ না হলে কর্মসংস্থান বাড়ানো যাবে না। এ সময় পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে সরকারের সকল পর্যায়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।

অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, সবার আগে একটি আধুনিক জ্বালানি নীতিমালা প্রয়োজন। তা না করে জোড়াতালি দিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এজন্য একের পর এক মাস্টার প্ল্যান ফেল করছে। বিদ্যুৎ খাতের বিশেষ বিধান বাতিল করতে হবে। টেন্ডার ছাড়া প্রকল্প নেয়ায় প্রতিযোগিতামূলক দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এখনও ১২ থেকে ১৩ টাকায় সৌর বিদ্যুতের চুক্তি হচ্ছে। অথচ দর প্রক্রিয়ায় গেলে এটি ৮ থেকে ৯ টাকায় করা সম্ভব।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের নামে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি সমন্বয় করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুৎ কিনছে। আবার কমিশনকে পাশ কাটিয়ে গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ জ্বালানির দাম বাড়াচ্ছে। কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, বিদেশ ভ্রমণ, ঘুষের টাকা, কমিশন সবই জনগণের টাকা থেকে মেটানো হচ্ছে। এরপরও জনগণকে কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না। ফলে এই বাজেট এলেই কী, আর গেলেই কী। বরং বাজেটে যত বেশি বরাদ্দ বাড়বে তত বেশি লুট হবে।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সরকারের ভুলনীতির কারণে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান ২০২৫ সাল নাগাদ ১৯৬ শতাংশ বেড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরকারের ভর্তুকি দেয়ার পরও এই লোকসান হবে। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জ্বালানি খাতের রূপান্তর ও টেকসই জ্বালানি খাত নিশ্চিতে গ্যাস এবং বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে যৌক্তিক প্রাধিকার পুনর্নির্ধারণ করে বাজেটের বরাদ্দে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা উচিত।

জ্বালানি খাতে সরকারের আমদানিনির্ভরতা আরও ঝুঁকি তৈরি করছে বলে মনে করছে সিপিডি। সংস্থাটি বলছে, দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে (২০২৪-২৫) জ্বালানি খাতে আগের চেয়ে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এটা স্ববিরোধী। এতে কূপ খননের কাজ ব্যাহত হতে পারে।

বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘শতভাগ ব্যর্থ বলার সুযোগ নেই। কিছুটা লোডশেডিং হলেও সারাদেশের মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। জ্বালানি সরবরাহ থাকলে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে এত কথা হতো না। মূল সমস্যা হচ্ছে প্রাথমিক জ্বালানির সংকট। আর পিডিবির লোকসানের পেছনে কেন্দ্র ভাড়ার দায় অতটা নয়, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আর্থিক চাপ বেড়েছে পিডিবির।’

বাংলাদেশ পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের রেক্টর মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে প্রথমবারের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়নে আলাদা করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, এটা ইতিবাচক। তবে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে কর-শুল্ক মিলে ৮৯ শতাংশ হয়ে যায়, এটা বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে বাধা। এটা কমাতে পারলে উৎসাহ বাড়বে।’

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০