অর্থনীতি অচলকারী বৈদেশিক ঋণ থেকে মুক্তির উপায়

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা গত ডিসেম্বরের শেষে ১০০ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। সেই সঙ্গে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণও বেড়ে দেড় লাখ ছাড়িয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিম্নগামী অবস্থান, পণ্য ও পরিষেবা রপ্তানি আয়ের মন্থর প্রবৃদ্ধিসহ ঋণের উচ্চ খরচ অস্থিতিশীল অর্থনীতিতে যেন ভয়াবহ অবস্থার সূত্রপাত ঘটাচ্ছে। 

বড় বড় অবককাঠামো নির্মাণ, বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নসহ নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য নেয়া ঋণের পরিমাণ গত সাত বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে সুদের পরিমাণ। আর সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় তা রূপান্তরিত হচ্ছে চক্রবৃদ্ধিতে।

ঋণ যেমন সুবিধা ভোগে সহায়ক, তেমনি পরিমাণ বেশি হলে অর্থনীতিকে অচল করে দিতেও সক্ষম। সেই পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থাও অসন্তোষজনক। সেজন্য সরকারের এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না, উল্টো বিদেশে অর্থ পাচার, উচ্চবিত্তদের উচ্চশিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য ডলারের বাড়তি খরচ এহেন পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তার বিষয়, যা ঋণ পরিশোধের পথকে আরও গতিহীন করছে।

অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, ঋণের এরূপ পরিস্থিতিতে জনগণের ওপর কর বাড়াতে। স্বল্প আয়ের বাংলাদেশে যেখানে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের বিশাল বৈষম্য বিদ্যমান, সেখানে সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি কর রীতিমতো অভিশাপ। তদুপরি সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে অনেকটা বাড়তি খরচের মধ্যে পড়ে আছে সবাই। সরকারি ঋণের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো করহার কমানো এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি।

তবে করহার বাড়িয়ে যদি শেষমেষ তা সাধারণ জনগণের কাঁধেই এসে পড়ে, তবে কল্যাণটা কোন দিক দিয়ে এসে দাঁড়ালো! তবে মোটা অঙ্কের ঋণ নেয়া ব্যক্তি, অথবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাড়তি করের আওতায় আনা দরকার।

ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটানোর জন্য বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ঋণ নেয়াটা কোনো অদ্ভুত বিষয় নয়। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পরিমাণ যেন অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিকরণে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ হাতে নিতে হয়। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রকল্প যদি সব হয় বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে, তখন সেটি সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশের টেকসই ম্যাক্রো স্থিতিশীলতার জন্য সঞ্চয়, বিনিয়োগ, রপ্তানি-আমদানি এবং রাজস্ব ঘাটতির পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিচক্ষণ সরকারের উপস্থাপনা অপরিহার্য বিষয়।

কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে সরকারকে আয় বাড়াতে হবে। নতুন ঋণ দিয়ে পুরোনো ঋণ পরিশোধ, অর্থাৎ রিফাইন্যান্সিং পদ্ধতিতে করতে হবে। যেমন ধরা যাক, এ বছর ১০ টাকা ঋণ নিলে আগামী বছরে পরিশোধ করার কথা। সেখানে এর মধ্যে আবার নতুন ঋণ না নিয়ে আগামী বছর আরও ১০ টাকার ঋণ নিয়ে পুরোনো ঋণটি পরিশোধ করা। এতে নতুন ও পুরোনো ঋণ একই থাকল এবং পরিশোধের সময়ও পাওয়া গেল। এর মধ্যে আয় থেকে পরবর্তী সময় শেষের ঋণ পরিশোধ সম্ভব হবে।

আরেকটি পথ খোলা আছে, সেটি হলো সরকারের আমদানির ওপর চাপ কমিয়ে আয়ের পথ আরও সম্প্রসারণ করা। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে বসবাসকারী বিদেশিরা পণ্যের গুণগত মান সন্তোষজনক না থাকায় ব্যবহার করতে চায় না। আমাদের দেশীয় পণ্যগুলোর দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। দেশীয় পণ্যগুলোর গুণগত মান উৎকৃষ্ট হলে বিদেশিরা আমাদের দেশে অবস্থান করে বাইরে থেকে আমদানি করবে না। ফলে আমাদের দেশীয় পণ্যের ব্যবহারও বৃদ্ধি পাবে, সেইসঙ্গে বৃদ্ধি পাবে আয় এবং বেঁচে যাবে বাড়তি ডলার খরচ। বাংলাদেশের একটি বড় বাস্তবতা হলো প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে অতিবিলম্ব। যেন দেশজুড়ে সারা বছর নির্মাণকাজ চলছে। এ কারণেই খরচের পরিমাণও বাড়তি হয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দুর্নীতির সুযোগ পায়। এ সমস্যা দূরীকরণে প্রকল্পগুলো শুরুর সঙ্গে সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব কাজ শেষ করতে হবে। দুর্নীতি যেন বাংলাদেশের পরতে পরতে  গেঁথে গেছে। আইন থাকা সত্ত্বেও কিছু অসাধু ও লোভী লোক কিছুতেই আইন মান্য করছে না। দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। সব ধরনের প্রশাসনিক দুর্বলতাকে উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থে দুর্নীতিবাজদের আইনের গোলটেবিলে বসাতে হবে। কেননা অনেক সময় দেখা যায়, প্রশাসনিক দুর্বলতার জের ধরেই দুর্নীতিবাজরা ছাড় পেয়ে যায়। উন্নত জীবনযাপন যদি আমাদের ঋণ নেয়ার লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে অর্থনীতিতে ভোগান্তি অচলবস্থা সৃষ্টি করবে, এরকম ঋণ কীভাবে হবে! তাই এ ব্যাপারে সরকারের সজাগ হওয়ার সময় এসেছে। পরিকল্পিতভাবে সব সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে নতুন ঋণের কথা ভাবতে হবে। কেননা বর্তমান পরিস্থিতির অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে ঋণের বৃদ্ধি মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।

 সাইশা সুলতানা সাদিয়া

শিক্ষার্থী, ইসলামি শিক্ষা বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০