অর্থনৈতিক অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাস রাখার দাবি

নিজস্ব প্রতিবেদক: তিন দিনের বাংলাদেশ বিজনেস সামিট গতকাল সোমবার শেষ হয়েছে। এবারের সামিটে যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, চীন, ভুটান, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ সাতটি দেশের মন্ত্রী, ১২টি বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ১৭টি দেশের ৩০০ জনের বেশি বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী নেতারা অংশ নিয়েছেন।

গতকাল ইনভেস্টিং ইন ইকোনমিক জোনস: প্রগ্রেস অ্যান্ড প্রায়োরিটি অপরচুনিটিজ ইন বাংলাদেশ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন বলেন, দেশের অন্য কোথাও বিদ্যুৎ-গ্যাস থাকুক কিংবা না থাকুক, অর্থনৈতিক অঞ্চলে তা সবসময় নিরবচ্ছিন্ন রাখতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় বড় শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ আসছে। তবে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ও সাপ্লাই চেইনে এখন বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ইপিজেএডকে অন্য অঞ্চলের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রোডাক্টে বিনিয়োগ আনতে হবে।

ডান অ্যান্ড ব্রাডস্ট্রিট সামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রাজেশ মিরচান্দানি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অবশ্যই উন্নতি করতে হবে। যদিও এ সূচক পরিমাপের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এনামুল হক বলেন, ফরেন কারেন্সি রেগুলেরেটরি অনেক দীর্ঘমেয়াদি। দেশের অধিকাংশ ফাইনান্সিয়াল প্রোগ্রাম সংস্কার করা হয়েছে। ক্যাশলেস সোসাইটি এর মধ্যে অন্যতম একটি, যা আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নেবে।

বাংলাদেশ সাপ্লাই চেইন সোসাইটির সিইও নকিব খান বলেন, ১০ লাখ কর্মসংস্থান হবে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চলে। আমাদের জন্য সাপ্লাই চেইন এখন বড় চ্যালেঞ্জের। এ খাতে আমাদের অনেক বিনিয়োগ করতে হবে। লজিস্টিক সাপোর্টেও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, ইকোনমিক জোন আছে। কিন্তু এর আউটসাইটে ডেভেলপ করতে হবে। বিমানবন্দরের উন্নতি করতে হবে। ওয়ার হাউসের নিয়ম অনেক পুরোনো। কাস্টমস এবং ওয়ারহাউসের আইন অন্যান্য দেশের মতো সংস্কার করে আধুনিক করতে হবে। এতে রাজস্ব আয়ও বাড়বে।

তিনি বলেন, রেল বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কার্গো পরিবহনে রেলকে কাজে লাগাতে হবে। লাস্ট ১৫ বছর ধরে এয়ারপোর্টে প্রফেশনাল স্ক্যানার নেই। এটা নিয়ে আমরা বলে আসছি। কিন্তু তারপরও কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই। এটা নিয়ে কাজ করা দরকার।

দুই মাসের মধ্যে দেশে চলবে ইলেকট্রনিক কার ও বাইক

এক থেকে দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশের রাস্তায় ইলেকট্রনিক কার ও বাইক চলবে বলে জানিয়েছেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমেদ। ‘ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ভবিষ্যৎ: বাংলাদেশে অটোমোবাইল এবং হাইটেক ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের সুবিধা’ শীর্ষক সেশনে তিনি এ কথা বলেন।

আব্দুল মাতলুব আহমেদ বলেন, বাজারে ইলেকট্রিক কার ও বাইক চলে এসেছে। আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে সরকারের নীতিমালাও আমরা পেয়ে যাব। তারপর থেকে ঢাকার রাস্তায় ইলেকট্রিক কার ও বাইক চলবে। অটোমোবাইল ও হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ শিল্পে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ রয়েছে। এখানে দেশি ও বিদেশিরাও বিনিয়োগ করতে পারবেন। দেশের অটোমোবাইল ও হাইটেক শিল্পকে এগিয়ে নিতে পোশাক খাতের মতো  সরকারকে পলিসি সুবিধা দিতে হবে। কারণ সরকারের পলিসি সুবিধা ছাড়া কোনো শিল্পেই উন্নতি হতে পারে না।

সেশনটি সঞ্চালনা করেন এফবিসিসিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট হাবিবুল্লাহ করিম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ফেয়ার গ্রুপের সিএমও মেজবাহ উদ্দিন, রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান এবং গ্রামীণফোনের সিইও ইয়াসির আজমান।

বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের আগে পরিবেশ দেখতে চান

বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগের আগে দেশের পরিবেশ দেখতে চান। তারা বিনিয়োগ যোগ্য পলিসি দেখে এর পরেই বিনিয়োগ করেন। বাংলাদেশে এ ধরনের পরিবেশ রয়েছে। ‘সার্কুলার ইকোনোমি’ শীর্ষক সেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং জাতীয় সংসদের সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী।

সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে যদি সুযোগ-সুবিধা বেশি হয় তবে এখানে বিদেশিরা বিনিয়োগ করবেন। এটা না হলে অন্য দেশে তারা চলে যাবেন। আমরা আমাদের উন্নয়নের পর্যালোচনা করছি, আবার নতুন করে কীভাবে উন্নয়ন করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করতে চাই আমরা।

তিনি বলেন, আমাদের ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতিতে রিসাইকেলিংয়ের অবস্থা কী হবে তা নিয়ে চিন্তা করার এখনই সময়। আগামী ৫০ বছরে আমরা কী করব তা এখনই ভাবার সময়। বিদেশি উদ্যোক্তারা এখানকার পলিসি-পরিবেশ দেখতে চায়। তাদের চয়েস রয়েছে, বিনিয়োগ পরিবেশ না থাকলে তারা চলেও যেতে পারে।

সাবের হোসেন বলেন, বিশ্ব কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ। উদ্যোক্তাদের বলব বাংলাদেশে বিনিয়োগের এখনই সময়, অন্যরা বিনিয়োগের আগে আপনারা চলে আসুন। এখানে বিনিয়োগ হবে সাশ্রয়ী।

সেমিনারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত সট চার্লস হোয়াইটলি বলেন, বিশ্ব এখন ডাবিং চক্রাকার অর্থনীতিতে জোর দিচ্ছে। ইইউ শুধু বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান বাজারই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক বাজার। আমরা কার্বণ নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনাসহ পরিবেশ রক্ষার শর্ত পূরণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করছি।

বেক্সিমকো টেক্সটাইলের প্রধান নির্বাহী (সিইও) সৈয়দ নাভিদ হোসেন বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা মুনাফার পেছনে ছুটি না। বিনিয়োগে আমরা শুরুতে মানুষ, এরপর প্রকৃতির দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। মানুষ এখন বিত্ত, বৈভব ও শক্তির দিকে ঝুঁকছে। মহামারিতে সেগুলো কাজে আসেনি। এখন আমাদের এসব পেছনে ফেলে টেকসই অর্থনীতি বিশেষ পরিবেশ ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, তৈরি পোশাক, নির্মাণসামগ্রী কিংবা ইলেকট্রনিকস সামগ্রীসহ মানুষের নিত্য ব্যবহার্য নানা পণ্যের কাঁচামাল আসে প্রাকৃতিক উৎস থেকে। দিনে দিনে কঠিন হচ্ছে প্রকৃতি থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ। ব্যবহারের পরেই পণ্যগুলো হয়ে যায় বর্জ্য। এটি পরিবেশের জন্য হুমকি। এসব সমস্যার সমাধান হলো এক পণ্যের বারবার ব্যবহার বা চক্রাকার অর্থনীতি।

‘২০৪০ সালের আগেই বাংলাদেশ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশ হবে’

২০৪০ সালের আগেই বাংলাদেশ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দেশ হবে। বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট সুবিধা, প্রবাসী আয়, দক্ষ জনশক্তি, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো বড় অবকাঠামো ও অভ্যন্তরীণ ভোক্তাবাজারের সুবিধা বাংলাদেশকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যাবে। এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন সামিটের শেষ দিন বিকালে সংবাদ সম্মলনে এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ৫০ বছরে বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের ভোক্তাবাজার হয়েছে, দক্ষ জনশক্ষি হয়েছে। বিপুল এ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে, অবকাঠামো হয়েছে। ৯০ বিলিয়নের জিডিপি থেকে ৪৭০ বিলিয়নের জিডিপি হয়েছে। যেসব বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে নতুন সক্ষমতা তৈরি হয়েছে, যা বিদেশি বিনিয়োগের নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হয়েছে।

তিনি বলেন, তিন দিনের বিজনেস সামিটে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী, ব্যবসায়ী নেতা, বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী, বিনিয়োকারীর আগ্রহ দেখে মনে হয়েছে বাংলাদেশ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে।

বিজনেস সামিটে বিপুলসংখ্যক বিদেশি প্রথমবারের মতো অর্থ ব্যয় করে রেজিস্ট্রেশন, বিদেশি মন্ত্রী-বিনিয়োগকারীর উপস্থিতি ও বিভিন্ন সেশনে অংশ নিয়ে আয়োজনকে সার্থক করেছে, বলেন এফবিসিসিআই সভাপতি।

সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা যারা আজ সফল উদোক্তা, ৫০ বছরের বাংলাদেশে জিরো থেকে হিরো হয়েছি। এ স্পিরিট থেকে আমরা ট্রিলিয়ন ডলারের দেশ হবো।

এই প্রথম বাংলাদেশ বিজনেস সামিট করেছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় কিছু ভুলত্রুটি হলেও সফলতাই বেশি। সফল হওয়ার অন্যতম কারণ ৮৯৬ জন সামিটে অংশ নিতে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। ৩০০র বেশি বিদেশি ডেলিগেট এসেছেন। সামিটে প্রতিটি সেশন ছিল প্রাণবন্ত। বেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীরা আগ্রহ নিয়ে সেশনগুলোয় অংশ নিয়েছেন। এরই মধ্যে সৌদি আরবের সঙ্গে চারটি ব্যবসায়িক চুক্তি হয়েছে। সৌদি আরও বিনিয়োগ করবে বলে জানিয়েছে। আরও কয়েকটি দেশের ব্যবসায়ীরা এখানে ব্যবসার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ সামিটের উদ্দেশ্য ছিল ব্র্যান্ডিং করা ও দেশের সক্ষমতা তুলে ধরা, এতে আমরা সফল হয়েছি।

সামিটে বিভিন্ন কৌশলগত বিষয়ে ৩ প্লেনারি সেশন, ১৪টি প্যারালাল সেশন, বিজনেস টু বিজনেস মিট, নেটওয়ার্কিং সেশন, একটি ওপেন হাউস রিসেপশন এবং আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের জন্য গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয় সামিটে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০