Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 11:23 pm

অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষি পর্যটন

 মারুফ হোসেন: বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান একটি দেশ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যখন কৃষি পর্যটন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, সেখানে কৃষি প্রধান এ দেশে কৃষি পর্যটনের বিকাশ না ঘটা মোটেও সুখকর নয়। ইতোমধ্যে এ দেশে পর্যটনশিল্প জনপ্রিয় শিল্পে পরিণত হয়েছে। মানুষের আর্থিক অবস্থায় পরিবর্তন এসেছে; তারা ঘুরে বেড়ানোকে জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে নিচ্ছে। তাই তো পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় সবসময় পর্যটকদের ভিড় লক্ষণীয়। এ দেশে কৃষি পর্যটন বিকাশের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। এ শিল্প বিকশিত হলে দেশের অর্থনীতি যেমনি এগিয়ে যাবে, তেমনি বেকারত্বের হারও কমে আসবে।

বর্তমানে কৃষি পর্যটন বিশ্বব্যাপী একটি জনপ্রিয় শিল্প হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এর মাধ্যমে পর্যটকরা সহজে মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে পারছে। বিষ মুক্ত, তাজা ফলমূল, শাকসবজি সংগ্রহ করতে পারছে। তারা বাগান বা ফার্ম থেকে নিজ হাতে পেরে তাজা ফলমূল খেতে পারে এবং পরিবারের জন্যও কিনে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফার্মে আবার শিশু-কিশোরদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে, তেমনি বড়রাও বিনোদনের পাশাপাশি মুক্ত, ফ্রেশ বাতাস গ্রহণ করতে পারেন।

কৃষির সঙ্গে মিশে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় কৃষি পর্যটন। কৃষি ও কৃষক যে সম্মানিত পেশা তা কৃষি পর্যটন আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দেয়। বাজারে গিয়ে একজন ক্রেতা মাছ কিনতে পারে ঠিকই কিন্তু কৃষি পর্যটন একজন ক্রেতাকে মাছ ধরারও সুযোগ করে দেয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন ফার্ম, খামারবাড়ি গড়ে ওঠলেও কৃষি পর্যটন তেমন বিকাশ লাভ করেনি। উদ্যোক্তারা চাইলে তাদের খামার পর্যটকদের জন্য উš§ুক্ত করে দিতে পারে। এতে তাদের পণ্য খামারেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ক্রেতার পেছনে তাদের ছোটা লাগছে না বরং ক্রেতাই তাদের পণ্য ক্রয়ের জন্য এগিয়ে আসছে। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই লাভ। বাজারে যে দামে পণ্য বিক্রি হয় তার চেয়ে কম দামে ফ্রেশ, টাটকা শাকসবজি আহরণ করতে পারছেন পর্যটকরা।

কয়দিন আগে একটি নার্সারিতে বেড়াতে যাই। দেখলাম সেখানে বিভিন্ন বয়সের মানুষ বেড়াতে এসেছে। কেউ কেউ ছোট ছোট গাছে ফুল দেখে, বিমুগ্ধ হয়ে ছবি তুলছে! আবার অনেকে সেখান থেকে চারাগাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের বাড়ির আঙিনায় লাগাবে বলে। কৃষি পর্যটন আমাদের শেকড়ের দিকে নিয়ে যায়। এটি পরিবারের সবার মাঝে মিষ্টি বন্ধন সৃষ্টি করে। মা-বাবা, ভাই-বোন প্রকৃতির সঙ্গে, কৃষির সঙ্গে তাদের সময় অতি মধুর ও প্রাণবন্ত করে তোলে। শহরের ইট-পাথরের দেয়াল থেকে কিছু সময়ের জন্য বেরিয়ে এসে পর্যটন কেন্দ্রে বা খামারে নিজ হাতে জাল মেরে মাছ ধরা, সাঁতার কাটা, গাছে ওঠে নারিকেল পেড়ে খাওয়া, ফ্রেশ ফলমূল খেতে পারা সত্যিই পরিবারের জন্য একটি আনন্দদায়ক বিষয়। কৃষি পর্যটন আমাদের সে আনন্দটুকু উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়।

কৃষিপ্রধান এ দেশে কৃষি অবহেলিত হলেও কৃষি পর্যটন কৃষিকে আরও সম্মানজনক স্থানে নিয়ে যাবে বলে আশা করি। এ ক্ষেত্রে তরুণ উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে পারে। গ্রামের তরুণ-তরুণীরা এ শিল্পকে কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠতে পারে। যারা অন্যের কাজ না করে, মানুষকে কাজ দেবে বলেÑসংকল্প করেছে তাদের জন্য এটি হতে পারে সোনায় সোহাগা। কোনো তরুণ যদি পর্যটনকেন্দ্রিক করে তার কৃষি খামারটি গড়ে তুলতে পারে, সেখানে পর্যটকদের সমাগম হবে। ফলে গ্রামের চাকরি প্রত্যাশী কিংবা বেকার যুবকদের কর্মের সুযোগ হবে; তাদের কর্মের সন্ধানে ঢাকা শহরে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। এমনিতেই রাজধানী ঢাকাকে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, বিভিন্ন প্রকার দূষণ, ট্রাফিক জ্যাম ইত্যাদির শিকার হয়ে থাকতে হচ্ছে বছরের পর বছর। কৃষি পর্যটন গ্রামে ছড়িয়ে গেলে কর্মসংস্থান গ্রামকেন্দ্রিক করা সহজ হবে। মানুষ প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে গ্রামের দিকে ছুটবে। পর্যটন বহুমাত্রিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। আশার কথা হলো, দেশে তরুণ উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। অনেকে ফুলের বাগান তৈরি করছে। কেউ কেউ শাকসবজির বাগান দিচ্ছে। অনেক নারী হাঁস-মুরগি, গরুর খামার দিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন; যা অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণার গল্প হচ্ছে।

দেশে কৃষি পর্যটনের প্রসার ঘটলে তৈরি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। একদিকে পুষ্টির চাহিদা পূরণ হবে পাশাপাশি মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যাবে। কৃষি পর্যটনে এনে নতুন প্রজন্মের কাছে কৃষির আদ্যোপান্ত তুলে ধরে, কৃষি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দূর করা যাবে তাদের। পুষ্টিকর খাবার আমাদের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক মানসিক প্রশান্তিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কৃষি পর্যটনে এলে আমরা দুটিই পাচ্ছি। যেন এক ঢিলে দুই পাখি! কৃষি পর্যটন আগ থেকে চলে এলেও আমাদের দেশে এটি অনেকটা নবীন। এখন এ শিল্পটি দেশে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। অনেক কৃষক কৃষি পর্যটনে আগ্রহী হচ্ছেন। এটির ধারণা যেন নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায় তার জন্য দরকার প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একজন শিক্ষার্থীর উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার একটি গল্প দেখতে পায়। ভিডিওটিতে দেখা যায় তিন একটি নান্দনিক ফুল ঘর গড়ে তুলেছেন। সেখানে শোভা পাচ্ছে দেশি-বিদেশি হাজার রকমের ফুল; যা দেখতে ও ফুল সংগ্রহ করতে পর্যটকরা সেখানে যাচ্ছে। সেখানে রয়েছে খাবার-দাবারের ব্যবস্থাও। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তরুণদের গাছগাছালির নার্সারি, ফুল চাষ ইত্যাদি করে স্বাবলম্বী হতে দেখা যায়। কিন্তু তাদের মাঝে যদি কৃষি পর্যটনের ধারণা ছড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে এ শিল্পে তরুণদের জন্য বিপুল কর্মসংস্থান তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাগুলোর একটি হলো বেকারত্ব। তখন এ সমস্যাটি অনেকাংশে কমে যাবে বলে আশা করি। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির গতিও ত্বরান্বিত হবে।

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়