অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ পর্যটন

মারুফ হোসেন: দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ, পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ কিংবা মাঠে কৃষকের ফসল ফলানোর দৃশ্য যে কারও মনে এনে দেবে প্রশান্তির ছোঁয়া। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা নদী, খাল, শাপলার বিল, শস্য-শ্যামল ক্ষেত, সারি সারি বৃক্ষরাজি, নির্মল বাতাস সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সহজেই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে টেনে নেয়। এখানকার মানুষের সহজ-সরল জীবনযাপন, তাদের অতিথিপরায়ণতা, আচার-ব্যবহার পর্যটকদের মন জয় করে নেয় নিমিষেই। এমন অসংখ্য গ্রাম ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এদেশের বুকজুড়ে। গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরে গ্রামীণ পর্যটনের বিকাশ সাধন জরুরি।

কর্মব্যস্ততার ফাঁকে একটু অবকাশ যাপনের জন্য অনেকেই মুখিয়ে থাকেন। শহরের যানজট, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে কার না মন চায়! তাই তো কর্মব্যস্ত অসংখ্য মানুষ অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে ছুটে যান টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। আবার কেউ কেউ হাতের কাছে কোনো পার্ক বা বিনোদন কেন্দ্রে ঘুরতে যান। এই ঘুরে বেড়ানোর প্রয়াস মানুষের সহজাত। তরুণদের মধ্যে আবার অনেকেই ভালো লাগা থেকে বেরিয়ে পড়েন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। দেখা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে গ্রুপ খুলে তরুণরা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য নতুন নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছে। তাদের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কিংবা ছবি অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করছে। পত্রিকার পাতা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মারফত তাদের ভ্রমণের নানা অভিজ্ঞতা জানতে পারি। দিন দিন তরুণদের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে। কাজেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর গ্রামগুলোতে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলা দরকার। এতে একদিকে যেমন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে পাশাপাশি দারিদ্র্যের হারও কমবে। অন্যদিকে ভ্রমণপিপাসুদের ভ্রমণ পিপাসা নিবারণ সম্ভব হবে।

গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অনেকে কৃষি শ্রমিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে কৃষিতে এসেছে পরিবর্তন। কৃষিতে নতুন নতুন যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে কৃষি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান সংকুচিত হচ্ছে। কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। গ্রামাঞ্চলে পর্যটনশিল্পের প্রসার ঘটানো গেলে তাদের কর্মসংস্থান তৈরি সম্ভব হবে। পাশাপাশি খেটে খাওয়া বা নিন্ম আয়ের মানুষরাও অর্থ উপার্জনের সুযোগ পাবে। দেখা যায়, শহরের কর্মজীবী মানুষ উৎসব, ছুটি কিংবা অবসর সময়ে নাড়ির টানে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। কিন্তু গ্রামে সেভাবে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে না উঠায়, ঘুরতে বের হলে তাদের পড়তে হয় যত সমস্যায়। গ্রামগুলোকে পর্যটন উপযোগী করে গড়ে তোলা গেলে শহর থেকে আসা স্থানীয় বাসিন্দা কিংবা পর্যটকরা গ্রামে ভ্রমণের প্রতি উৎসাহী হবেন।

গ্রামীণ পর্যটনের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো গেলে এটি জাতীয় অর্থনীতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। গ্রামে এ খাত বিকশিত হলে পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার ওপর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ কমবে। গ্রামের মানুষকে কাজের সন্ধানে শহরমুখী হতে হবে না। গ্রামের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। পর্যটন স্পট ঘিরে গ্রামে গড়ে উঠবে হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, পার্ক, মার্কেট যা তাদের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য অক্ষুণœ রেখে পাকা রাস্তা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিদ্যুতের চাহিদা পূরণসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে শহর ও গ্রামের জীবন যাত্রার মানের বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব হবে। এতে পর্যটকরাও গ্রামমুখী হবে। বিদেশি পর্যটকদের সবুজ প্রাকৃতিক স্পটগুলোর দিকে ঝোঁক বেশি। এক্ষেত্রে তাদের নিরাপদ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, বিনোদন, যাতায়াতসহ যাবতীয় সুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হলে তারা গ্রামীণ পর্যটনের প্রতি আকর্ষিত হবেন। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা।

আশার কথা হলো, তরুণরা ভ্রমণের প্রতি অনেক বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। বন্ধুদের নিয়ে দল বেঁধে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা বাংলাদেশ। আবার অনেকে এটিকে বাণিজ্যিক রূপ দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলেই চোখে পড়ে তরুণদের একাধিক গ্রুপ। যেগুলোর মাধ্যমে তারা অন্যদের ভ্রমণের প্রতি উৎসাহিত করেন, পাশাপাশি ভ্রমণের স্পট সম্পর্কে এবং ওই স্পটগুলোয় কীভাবে কম খরচে যাওয়া যায় তারও উত্তর মেলে তাদের পোস্ট ও কমেন্টের মাধ্যমে। নারীরা যাতে সহজে ভ্রমণে বের হতে পারেন তার জন্যও অনেক নারী উদ্যোগী হচ্ছেন। তরুণদের ঘুরে বেড়ানোর এমন আগ্রহ পর্যটনশিল্পের বিকাশে একটি আশা জাগানিয়া দিক। পর্যটনশিল্পের প্রসারে প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে এ খাত হয়ে উঠবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার।

দেখা যায়, অনেক গ্রাম নদীর তীরে অবস্থিত, কোনো কোনো গ্রাম আবার পাহাড়ের পাদদেশে। দেশের প্রতিটি গ্রামই চোখ জুড়ানো অপরূপ সৌন্দর্যে সেজে আছে; যা প্রতিটি হƒদয়ে এক অদ্ভুত দোলা দেয়। পর্যটকদের কাছে টানে। কিন্তু এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও গ্রামীণ পর্যটন বিকশিত হয়নি। যার ফলে গ্রামের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। করোনাকালে গ্রামে বেকারত্বের হার বেড়েছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষে আয় কমেছে। দেশে করোনাকালে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ। সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসোর্স সেন্টারের (পিপিআরসি) যৌথ জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ অবস্থায় নতুন কর্মসংস্থান তৈরির বিকল্প নেই। সে ক্ষেতে পর্যটন খাত আমাদের আশান্বিত করে।

গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় এখানে কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনাও অনেক বেশি। পর্যটকরা কৃষি খামারে গিয়ে এ সম্পর্কিত নানা বিষয় জানতে পারবে, উপলব্ধি করতে পারবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে কৃষি পর্যটন। এর ফলে পর্যটকরা যেমনি নতুন শস্যের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন, তেমনি টাটকা শাকসবজি ও ফলমূল আহরণ করতে পারছেন। গ্রামে কৃষি পর্যটনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো গেলে কৃষকরাও আর্থিকভাবে লাভবান হবেন। পাশাপাশি বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান তৈরি হবে।

মোদ্দা কথা হলো, গ্রামীণ পর্যটন খাত বিকাশে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, আবাসন ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠে এ খাতকে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার মাধ্যমে গ্রামের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধন এখন সময়ের দাবি।

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০