Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:22 pm

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আমানত সুরক্ষায় ইসলামী ব্যাংক

মো. মাঈনউদ্দীন: বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সাল থেকে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির সফলতা ও কল্যাণমুখী উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের হƒদয়ে স্থান করে নিয়েছে। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত প্রায় ২ কোটি গ্রাহকের অকুণ্ঠ ভালোবাসায় ব্যাংক অব্যাহত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের অব্যাহত সাফল্য  ও অগ্রগতি দেখে দেশে প্রচলিত ধারার অনেক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং শুরু করেছে। এ পর্যন্ত দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংক ১১টি প্রচলিত ব্যাংকের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের শাখা এবং ১৪টি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির পথ ধরে ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আল-বারাকা ব্যাংক; যা বর্তমান আইসিবি ইসলামী ব্যাংক নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এরপর ১৯৯৫ সালে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। দেশের প্রচলিত ব্যাংকিং ধারা ছেড়ে ২০০৪ সালে ১ জুলাই ইসলামী ব্যাংকিংয়ের আসে এক্সিম ব্যাংক। ২০০৯ সালে ১ জানুয়ারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক সুদভিত্তিক ব্যাংক পরিহার করে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক নাম ধারণ করে। এরপর ২০১৩ সালে আসে ইউনিয়ন ব্যাংক। ২০২১ সালে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। এছাড়া বহুজাতিক এইচএসবিসি ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ইসলামী ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি সারাদেশে ৩৯৪টি শাখা, ২৩৭টি উপশাখা ও প্রায় ৩ হাজার এজেন্ট আউটলেটের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া এটিএম, সিআরএমসহ ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের নানা প্রোডাক্টের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সফল অংশীদার। বর্তমানে এ ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ৩১ ডিসেম্বর ২০২২-এ যেখানে ব্যাংকের আমানত ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ২০০ কোটি টাকা; যা ৩০ জুন ২০২৩-এ ছিল ১ কোটি ৪৮ হাজার কোটি টাকা। দেশের সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংককে ছাড়িয়ে শীর্ষে আছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। আমানতেও ইসলামী ব্যাংক সবার শীর্ষে। ২০২১ সাল শেষে ইসলামী ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে এই ব্যাংকের আমানতে প্রায় এক লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। শুধু আমানতে নয় ঋণ/বিনিয়োগ, রেমিট্যান্সেও ইসলামী ব্যাংক শীর্ষে। বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে এই ব্যাংকের; যা দেশের মোট বিনেয়োগের ১২ শতাংশের বেশি। বৈদেশিক মুদ্রায় শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। সারাবিশ্ব থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে তার ২৯ শতাংশ আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। আরব দেশগুলো থেকে যেসব রেমিট্যান্স আসে তার ৫২ শতাংশ আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের ইসলামী ব্যাংক শীর্ষে রয়েছে। সারাদেশে প্রায় ৩০ হাজার গ্রামের ১৬ লাখ গ্রাহক এই ব্যাংকের পল্লি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। যার ৯২ শতাংশই মহিলা। গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত ও বেগমান করতে এসব মহিলারা ভূমিকা পালন করে আসছে। ইসলামী ব্যাংক দেশের কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উপৎপাদন, বিপণন ও বিতরণেও ভূমিকা পালণ করে আসছে। কৃষি খাতকে চাঙ্গা করতে করোনাকালেও ইসলামী ব্যাংক কৃষকের মাঝে বীজ সার ও কৃষি উৎপাদনে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। তৈরি পোশাক, নিত্যখাদ্য পণ্য, পরিবহন, আবাসন, চামড়া ও চিংড়িসহ শিল্প খাতেও বিনিয়োগের শীর্ষে ইসলামী ব্যাংক। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পাশাপাশী বৃহৎ শিল্পগ্রুপ, সিটি গ্রুপ, এসআলম গ্রুপ, আবুল খায়ের, বিআরবি, বসুন্ধরা, যমুনা গ্রুপসহ নামকরা শিল্প গ্রুপে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে। এই ব্যাংকের আমানত সংরক্ষণ, বিনিয়োগ প্রদান কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের এম বিস্তৃতি সম্ভব হয়েছে গ্রাহকের ভালোবাসা, বিশ্বস্ততা ও সহযোগিতার মাধ্যমে। কাজেই এ ব্যাংকের সঙ্গে আমানতকারী ও বিনিয়োগ গ্রাহকসহ শুভাকাক্সক্ষীদের আস্তা অনেক মজবুত। প্রবাসী বন্ধুদের বিশ্বস্ত ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধা, প্রবাসী ভাই বোনদের আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে আহরণের ভূমিকা পালন করছে ইসলামী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, এককভাবে দেশের এক তৃতীয়াংশ রেমিট্যান্স আহরিত হয় এই ব্যাংকের মাধ্যমে। দেশের প্রায়  ২ কোটি গ্রাহক আস্থার সঙ্গে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা জমা রেখেছে এই ব্যাংকে; যা দেশের মোট আমানতের এক দশমাংশ। ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৮৮ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এই ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান অবস্থান পরিষ্কার করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেছে, শরিয়াহ ব্যাংকগুলো অনেক ভালো অবস্থানে আছে। এমনকি প্রবাসী রেমিট্যান্সের ৫২ শতাংশ অর্থ আসে শরিয়াহ ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসলামী ব্যাংকের অবদানকে মূল্যায়ন করছে। সিঙ্গাপুর ভিত্তিক দ্য এশিয়ান ব্যাংকার্স ম্যাগাজিন ইসলামী ব্যাংককে ‘স্ট্রংগেস্ট ব্যাংক ইন বাংলাদেশ’ অ্যায়ার্ড প্রদান করেছে; যা এ দেশের ব্যাংকিং ও অর্থনীতির জন্য একটি বড় স্বীকৃতি। এছাড়া বিগত ১০ বছর ধরে বিশ্ব সেরা ১ হাজার ব্যাংকের তালিকায় ইসলামী ব্যাংক দেশের শক্তিশালী ব্যাংক হিসেবে অবস্থান করছে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ৪০ বছর পথ চলায় দেশের আরও ৯টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকের পথ চলাকে সুগম করেছে। কাজেই এই ব্যাংকের প্রতি জনগণের আস্থা এত সহজেই দুর্বল হওয়ার নয়। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে যে ব্যাংকটির আস্থাও বিশ্বাসের সঙ্গে জনগণের আমানতের হেফাজত করছে, তা এত সহজে নষ্ট হওয়ার নয়। এ ব্যাংকের কর্মচারীদের সঙ্গে গ্রাহকের আন্তরিকতা ও আস্থা বিরাট শক্তি। দেশের অর্থনীতিকে যে ব্যাংক নেতৃত্ব দিচ্ছে সেই ব্যাংক সম্পর্কে নানা গুজবে গ্রাহকেরা ভীত নয়। তারা  তাদের আমানত এ ব্যাংকেই রেখে যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কাঠামো পণ্য বেচাকেনার সহিত সম্পৃক্ত থাকায় এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও কম। ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল অ্যাপস চালু ও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রসার ঘটিয়েও ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের সেবা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে অবদান রাখাসহ সামাজিক কর্মকাণ্ডে যেমন গরিব মেধাবীদের বৃত্তি প্রদান, দরিদ্রদের মাঝে বিভিন্ন সময় নানা সাহায্য প্রদান হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারা প্রবর্তন, ভারসাম্য ও শোণনমুক্ত সমাজ ও সম্পদের সুষম বণ্টনের কাজ করার ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ইসলামী ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে।

বর্তমানে দেশে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট আমানত প্রায় ৪ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি; যা ব্যাংকের মোট আমানতের ২৭ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংকগুলোর মোট বিনিয়োগের প্রায় ৩ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকারও বেশি; যা ব্যাংক খাতে মোট বিনিয়োগের ২৯ শতাংশ। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো অনেক অবদান রেখে চলেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা মোট রেমিট্যান্সের ৫২ শতাংশ আসছে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমানত, মুনাফায়  ও অপারেটিং বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। দেশের মোট বিনিয়োগের প্রায় ১২ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ ইসলামী ব্যাংকের। বৈদেশিক মুদ্রার শীর্ষে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। সারাবিশ্ব থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আসে তার ২৯ শতাংশ আসে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে। পল্লি উন্নয়নেও ইসলামী ব্যাংকগুলো কাজ করে যাচ্ছে। দেশের কৃষি শিল্প কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন, বীজ সার সরবরাহ, গার্মেন্টস খাতে ইসলামী ব্যাংকগুলো অনন্য অবদান রেখে চলেছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, গ্রামের দরিদ্র শ্রেণির মাঝে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ বিতরণে ও নানা আর্থিক সাহায্য ইসলামী ব্যাংকগুলো কাজ করে যাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রবৃদ্ধি ও উন্নতির অন্যতম কারণ হলো, মানুষের আস্থা ও ব্যাংককর্মীদের এক অনিষ্ট কর্মতৎপরতা।

দেশপ্রেমিক কৃষক ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের প্রিয় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংকে তারা আমানত রেখে এতদিন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিল। ভবিষ্যতেও এই ব্যাংকের আমানত নিরাপদে থাকবে এ প্রত্যাশা সব গ্রহকের। ব্যাংক কর্তৃপক্ষও তাদের গ্রাহক সেবা ও গ্রাহকের ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমানতগুলো সঠিকভাবে সঠিক স্থানে বিনিয়োগ করে সুদমুক্ত মুনাফা উপহার দেবেন এটিই সবার প্রত্যাশা।

ব্যাংকার