অর্থনৈতিক মুক্তি নারীর জীবন বদলে দেয়

সফল নারী উদ্যোক্তা রীনা রানী সাহা। নারীদের জন্য লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের দক্ষিণ তেমুহনী এলাকায় গড়ে তুলেছেন ‘রীনা বুটিকস অ্যান্ড টেইলার্স’। ২০১৮ সালে সরকারিভাবে সফল নারী জয়িতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। সম্প্রতি এক আলাপনে তার ১৭ বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা, সফলতা ও আগামী পরিকল্পনার কথা জেনেছেন জুনায়েদ আহম্মেদ

আপনার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী..

রীনা রানী সাহা: চাঁদপুরের বাসিন্দা হলেও আমি পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর রামপুরায় থাকতাম। সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে এইচএসসি ও ১৯৯৭ সালে আবুজর গিফারী ডিগ্রি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করি। ২০০১ সালে লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গৌরচন্দ্র সাহার সঙ্গে বিয়ে হয়। আমাদের দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে শহরের ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে নবম শ্রেণি ও ছোট ছেলে লক্ষ্মীপুর কালেক্টরেট উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। স্বামীর সীমিত আয় দিয়ে সাংসারিক চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতাম। তাই পরিবারের সচ্ছলতা বাড়ানোর পাশাপাশি নিজেকে আত্মনর্ভরশীল করতে গড়ে তুলেছি ‘রীনা বুটিকস অ্যান্ড টেইলার্স’।

আপনার উদ্যোগ সম্পর্কে বলুন…
রীনা রানী: ডিগ্রিতে পড়ার সময় ব্যবহারিক পরীক্ষায় মেয়েদের ফ্রক বানাতে হয়েছে। তখন যে আনন্দ পাই, তা থেকেই আমার ব্যবসার চিন্তা আসে। পরে ঢাকা বিসিক শিল্প থেকে বুটিকস ও টেইলারিংয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিই। এরপর ভাইয়ের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনি। প্রথমে
রামপুরায় ঘরে বসে পাড়া-প্রতিবেশী থেকে অর্ডার নিয়ে স্বল্পপরিসরে ব্যবসা শুরু করি। ২০০১ সালে বিয়ের পর লক্ষ্মীপুরে স্বামীর বাড়িতে চলে এলেও থেমে থাকেনি আমার ব্যবসায়িক পথচলা। স্বামীর প্রেরণা ও ভাইদের অর্থনৈতিক সহযোগিতায় প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন সৃষ্টির নেশায়
লক্ষ্মীপুর শহরের দক্ষিণ তেমুহনী এলাকার মনা মাস্টারের দরজা নামক স্থানে মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে প্রথমে দোকান দিই। এরপর ব্যবসার প্রসার ঘটাতে একই এলাকার শেখ রাসেল সড়কে দোকান স্থানান্তর করি।

চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোগী হওয়ার কারণ…
রীনা রানী: চাকরিতে অনেক প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়। স্বাধীনতা নেই। এজন্য ব্যবসার পথ বেছে নিয়েছি।

প্রতিষ্ঠান গড়তে কার সহায়তা পেলেন?
রীনা রানী: আমার আগ্রহ ও পরিশ্রমকে স্বাগত জানিয়ে স্বামী ও ভাই দোকান দেওয়ার পরামর্শ দেন। স্বামী তেমন কোনো আর্থিক সহযোগিতা করতে পারেননি। তাই ভাইয়ের কাছ থেকে স্বল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। পরে ব্যবসার মুনাফা থেকে তার ঋণ পরিশোধ করি।
আপনার প্রতিষ্ঠানের বিশেষত্ব কী?
রীনা রানী: উন্নতমানের দেশি কাপড়ের সমারোহে সাজানো আমার প্রতিষ্ঠানটি। আমি নিজেই বুটিকসের কাজ করি। ঢাকা থেকেও করিয়ে আনি। মিল্ক প্রিন্ট, অর্গেন্টি, সুতি, বাটিক, ব্লক, আড়ংয়ের কাপড়, সুতির কাপড়, হ্যান্ড ব্যাগ ও বিভিন্ন ডিজাইনের কাপড় কম দামে এখানে পাওয়া যায়। বর্তমানে ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে চার হাজার টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন মূল্যের পণ্য আমার প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। এছাড়া মেয়েদের সব ধরনের পোশাক ও বোরকা সেলাই করে থাকি।

ব্যবসায়িক সফলতা সম্পর্কে বলুন…
রীনা রানী: মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করি। আজ আমি সফল বলতে পারেন। বর্তমানে আমার প্রতিষ্ঠানে ছয় লাখ টাকার বেশি মূলধন রয়েছে। প্রাথমিকভাবে নিজেই ব্লকের কাজ করতাম। বিভিন্ন দোকান থেকে কাজের অর্ডার নিতাম। কিন্তু ন্যায্য দাম না পাওয়ায় অর্ডারের কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। এখন এখান থেকেই বিক্রি করছি। বর্তমানে প্রতি মাসে আমার আয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। আমার এখানে একজন নারী ও তিনজন পুরুষ শ্রমিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে দুজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরি দিয়েছি। আমার কাজকে প্রাধান্য দিয়ে শহরের নামি-দামি অনেক প্রতিষ্ঠান পার্টটাইম কিংবা ফুলটাইম চাকরির প্রস্তাব দিলেও তা আমি গ্রহণ করিনি। কেননা, আমি চাই নিজের প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এছাড়া ২০১৮ সালে সরকারিভাবে জেলা পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী সফল নারী জয়িতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। আমি সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। সম্প্রতি সমাজসেবা অধিদফতরের অধীনে ৫০ হিজড়াকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি।

এ পর্যন্ত আসতে কোনো সমস্যায় পড়েছেন কি?
রীনা রানী: বিয়ের পর ব্যবসার শুরুটা আমার জন্য ছিল খুবই কষ্টের। কেননা, ঘরে বৃদ্ধ শ্বশুর, ছোট দুই সন্তান ও স্বামীকে রেখে কাপড়ের জন্য ঢাকায় যাওয়া-আসা করা খুব সহজ ছিল না। ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের অনেক কটূক্তি শুনতে হয়েছে। অনেকে আমাকে ও আমার প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত। সরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে গেলে নানা শর্ত আর নিয়মনীতির কারণে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে পারিনি। তবুও সব প্রতিকূলতাকে হার মানিয়ে আজ আমি সফল।

ব্যবসার সমস্যা সমাধানে কী করা যেতে পারে?
রীনা রানী: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করা উচিত। সরকারি নিয়মনীতি আরও শিথিল করলে ভালো। ব্যাংকের সুদহার বেশি হলে প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। স্বল্প শর্তে সরকারি ঋণ ও বিভিন্ন সহায়তা পেলে আমার প্রতিষ্ঠানের প্রসার ঘটাতে পারব। এতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অনেক বেকারের পাশে দাঁড়াতে পারব।

ব্যবসায়িক প্রেরণা সম্পর্কে বলুন…
রীনা রানী: আরআর কোল্ডস্টোরেজ লিমিটেডের রোকেয়া আফজাল রহমান, বিবি প্রোডাকশনের বিবি রাসেল ও কে.কে. এন্টারপ্রাইজের সীমা রোজারিও প্রতিষ্ঠিত সফল নারী। তাদের আমি চলার পথের পাথেয় মনে করি।

আগামীতে প্রতিষ্ঠানকে কোন অবস্থানে দেখতে চান?
রীনা রানী: আমার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মমুখী ও আত্মনির্ভরশীল করতে চাই। সরকারি সহযোগিতা পেলে পাট দিয়ে ব্যাগ, ম্যাট ও বাস্কেট তৈরি করে তা বাজারজাত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

নতুন উদ্যোক্তা সম্পর্কে কিছু বলুন…
রীনা রানী: দেশের লাখ লাখ নারী একসময় পুরুষের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল থাকলেও বর্তমানে তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে। পুরুষরা ইতিবাচকভাবে নারীর ক্ষমতায়নকে স্বাগত জানাচ্ছে। চাকরির পেছনে না ছুটে নারীদের উচিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা।
শুধু প্রশিক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তা বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে হবে। আমি মনে করি, অর্থনৈতিক মুক্তিই পারে একজন নারীর জীবন বদলাতে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০