অর্থনৈতিক সংকট ও এর দায়ভার

আলী আহসান : স্বাধীন-সার্বভৌম আমাদের এই বাংলাদেশ। এদেশের অর্থনীতি মূলত কৃষি থেকে উৎপাদনমুখী শিল্পে পরিবর্তনশীল অর্থনীতি। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় একটি অংশ হচ্ছে রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাকশিল্প। একটি দেশে যত বেশি বাণিজ্য হয় এবং  মুদ্রা যত বেশি গতিশীল থাকে, ততই সেদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঘটে। এ লক্ষ্যেই উৎপাদনমুখী বাণিজ্যিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে।

ব্যাংক হলো আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান জনগণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে স্বল্প সুদে অর্থ সংগ্রহ করে এবং সংগৃহীত অর্থ অধিক সুদে ঋণ প্রদান করে। ঋণের সুদ ও সংগৃহীত অর্থের সুদের পার্থক্যই ব্যাংকের মুনাফা। উপর্যুক্ত এই সমীকরণে ব্যাংক খাতকে অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত বলা যায়। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ব্যাংক খাত বেশ একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই।

বিগত কয়েক বছরের সূচক দেখলে বিষয়টি স্পষ্টতই বোঝা যায়। ব্যাংক খাতে  অনিয়ম আর ঋণখেলাপি যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যসূত্র অনুযায়ী, বিগত পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণের চিত্রÑ২০১৯ সালে খেলাপি ঋণ ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, ২০২০ সালে খেলাপি ঋণ ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, ২০২১ সালে খেলাপি ঋণ এক লাখ তিন হাজার ২৭৩ কোটি টাকা এবং ২০২২ সালে খেলাপি ঋণ এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালের ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা থেকে ৬৪ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অবলোপনকৃত ঋণ ও পুনঃতফসিলকৃত ঋণসহ মোট সমস্যাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকা।

উপর্যুক্ত তথ্যানুসারে, শুধু ২০২০ সালে দেশজুড়ে কভিড-১৯-এর কারণে কিছুটা অর্থনৈতিক স্থবিরতা থাকার ফলে ঋণখেলাপি তুলনামূলক কমেছিল, কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোয় লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে।

উপর্যুক্ত এই পরিস্থিতির জন্য ব্যাংক খাতের নানা অনিয়ম দায়ী। স্বজনপ্রীতি, জামানতবিহীন ঋণ প্রদান, রাজনৈতিক আধিপত্য প্রভৃতির ফলে এই সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এই দায়ভার বহন করতে হচ্ছে দেশের সমগ্র মানুষকে, বিশেষত নিম্ন আয় ও মধ্যবিত্ত মানুষকে, কারণ সমাজের দুর্নীতিগ্রস্ত উচ্চবিত্তরাই অর্থ আত্মসাৎ করে। অর্থ আত্মসাৎ ও ঋণখেলাপি নিঃসন্দেহে মন্দ কাজ, তবে এর মধ্যেও একটা ব্যবস্থা যদি হতো তবে তা মন্দের ভালো হতো। যেমন খেলাপি ঋণ ও অর্থ আত্মসাৎ করা অর্থ যদি দেশের ভেতরেই থাকত, তবে হয়তো সেটা মন্দের ভালো হতো। কারণ দেশের অর্থ দেশে থাকলে অন্ততপক্ষে সামগ্রিক একটা ফল লাভ হতো। কিন্তু আমাদের দেশে যারা ঋণ খেলাপ করে, তারা দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করে ফেলে। জনগণের টাকা মেরে দুর্নীতিগ্রস্ত ওই ব্যক্তি বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করে বিলাসী জীবনযাপন করে। আর খেটে খাওয়া মানুষ অধিক কর দিয়ে তা পরিশোধ করে যায় অবিরাম।

ঋণখেলাপির ফলে দেশ থেকে টাকা চলে যায় এবং ব্যাংকের রিজার্ভে ঘাটতি দেখা দেয়। বিগত বছরগুলো থেকে বর্তমান বছরে ব্যাংকে রিজার্ভের পরিমাণ অনেক কমেছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের মে মাসে রিজার্ভ ছিল চার হাজার ২২৯ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের মে মাসে কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪২১ কোটি টাকা ডলারের মূল্যে এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার।

এছাড়া এর ফলে দেশে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় এবং ডলারের দাম বেড়ে যায়। ফলাফলস্বরূপ জিনিসপত্রে দাম অধিক হারে বৃদ্ধি পায়। ঋণখেলাপির মতো ডলারের দামও লাফিয়ে বেড়েছে। ছোট্ট একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো, ২০২২ সালে মে মাসে ডলারের মূল্য ছিল ৮৭ দশমিক ৯০ টাকা, যা ২০২৪ সালের মে মাসে হয়েছে ১১৭ দশমিক ৯১ টাকা।

একটি দেশের আর্থ-বাণিজ্যিক ও জীবনযাত্রার মান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, দেশের আমানতকৃত টাকার সুদের হার যত বেশি হয়, ততই জনগণ বিনিয়োগ ও সঞ্চয় করতে আগ্রহী হয়। অন্যদিকে ঋণের সুদের হার যত বৃদ্ধি পায় ততই বিনিয়োগ হ্রাস পায়। কারণ অধিক পরিমাণ দায় নিয়ে কেউ উৎপাদন করতে চায় না, কারণ এতে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বেড়ে যায়। ফলে ঋণের সুদ একটি দেশের অর্থনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে ব্যাংক খাতে ঋণের সুদের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের মে মাসে ঋণের সুদের হার ছিল ৯ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে হয়েছে ১৬ শতাংশ। সুদহার বাড়লে পণ্য ও সেবার উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে। বর্তমানে সব দিক থেকেই ব্যবসায়ীদের ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। তবে সুদের হার বৃদ্ধি পেলে ঋণের পরিমাণ কমে যায়, অর্থাৎ ঋণখেলাপিও কমে আপাতভাবে। কিন্তু ব্যবসায়িক গতিশীলতা হ্রাস পায়, যা অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে।

সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিচ্ছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, ঋণখেলাপি, রিজার্ভ হ্রাস, সুদের হার বৃদ্ধি প্রভৃতি আর্থিক সংকট সৃষ্টির মূল কারণ। কথিত বুর্জোয়া শ্রেণির আর্থিক দুর্নীতি এ ধরনের সংকট তৈরি করে যাচ্ছে। আর এর ফলে বাজার ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে, আর ভোগান্তির শিকার হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। স্পষ্টতই এখানে একদল সুবিধাভোগী বা শোষক আর আরেক দল শোষিত। সমাজের এরূপ বৈষম্য হ্রাস করতে হলে সরকারি প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে, তা না হলে জীবনভর উচ্চবিত্ত দুর্নীতিবাজদের ঋণের দায় বহন করতে হবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত সমাজকে।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০