Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 10:06 pm

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন বৃত্তিমূলক শিক্ষা

. নাবিল কাদির: বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা আবুল খায়ের পাটোয়ারীর অনুপ্রেরণায় ২০১৩ সালে ইঞ্জিনিয়ার নীলা প্রতিষ্ঠা করেন উইমেন ইন ডিজিটাল। এ দেশে নারীদের টেকনোলজি নিয়ে কাজের প্রতি ঝোঁক সে রকম চোখে পড়ে না। সে সময় বাবার উৎসাহে দেশের নারীদের নিয়ে কিছু করার লক্ষ্যে সময়োপযোগী একটা পদক্ষেপ নেন নীলা। দেশের মোট জনসংখ্যার  অর্ধেকই নারী। নীলা ভাবলেন, সেই নারীরাই যদি পিছিয়ে থাকে তাহলে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে নানা বাধা আসতেই পারে। তাই তার প্রতিষ্ঠিত উইমেন ইন ডিজিটালের মাধ্যমে তিনি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ১০ হাজারের বেশি নারীকে আইটি প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং সাত হাজারের বেশি নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশের পাঁচটি ভিন্ন গ্রামে এবং নেপালে তাদের টেকনিক্যাল স্কুল রয়েছে। যে স্কুলগুলোয় তারা নারীদের বিভিন্ন টেকনিক্যাল বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে নারীর প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ এবং উইমেন ইন ই-কমার্স, উইমেন ইন সাইবার সিকিউরিটি, হেলথ টেক এবং অ্যাগ্রো টেক নিয়ে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। নিজের দেশের ঐতিহ্য এবং ইতিহাসকে সম্মান রেখে বরাবরই নানা পদক্ষেপ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। ঠিক তেমনভাবেই নারী দিবসকে সামনে রেখে তারা নারীদের জন্য নিয়ে এসেছে Q www.womenine-commerce.com or www.womeninecommerce.com.bd নামে একটি ই-কমার্স মার্কেটপ্লেস। যেখানে বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারেন। তাদের কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে হয় না। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য দেশের সর্ব প্রথম মার্কেটপ্লেস এটাই।

প্রতিবছর ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে যে দিবস পালিত হতো, এ বছর থেকে তা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস’ হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও এ বছর দিনটি পালিত হচ্ছে না। বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি ভিত্তি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এগুলো হলোÑস্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি। স্মার্ট সিটিজেন তৈরি করতে হলে আমাদের সুশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি করতে হবে। সরকার ধ২র তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর নাগরিক সেবা সহজীকরণে নানা উদ্ভাবনী উদ্যোগে সহযোগিতা করছে। ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বিনির্মাণে সহযোগিতা করছে এটুআই। ই-পার্টিসিপেশনে ২০ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৭৫তম এবং জাতিসংঘ ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে ৮ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৪০ লাখ ৭৭ হাজার ২০৩ জন এবং নারী ৮ কোটি ৫৬ লাখ ৫৩ হাজার ১২০ জন। মোট জনসংখ্যার ৬৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ গ্রামে এবং ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ শহরে বাস করেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২২ শতাংশ। বিশ্বে বর্তমানে কমবেশি ১৭৪টি দেশে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি কর্মরত আছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ১২ লাখ ৪ হাজার কর্মী বিদেশে গেছে। গত বছর এ সংখ্যাটি ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার। এর মধ্যে ২ লাখেরও বেশি দক্ষ শ্রমিক এবং ৯ লাখেরও বেশি অদক্ষ শ্রমিক। সব মিলিয়ে করোনার পর বিদেশের শ্রমবাজারে নতুন করে ২৫ লাখ বাংলাদেশি যুক্ত হয়েছে। এ বছর শ্রম অভিবাসনের একটি ইতিবাচক দিক হলো, মধ্যপ্রাচ্যের প্রচলিত বাজারগুলোর পরিবর্তে ইতালি এবং যুক্তরাজ্যের মতো অপ্রচলিত গন্তব্যে রেকর্ডসংখ্যক কর্মী গেছে।

২০২২-২৩ সালে এসব প্রবাসী বৈধ চ্যানেলে প্রায় ২১.৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এক লাখেরও বেশি নারী কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের থেকে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার কথা তা আসছে না।  এর অন্যতম কারণ হলো দক্ষ জনবলের অভাব। প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে সারা পৃথিবী এখন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো কায়িক শ্রমের স্থান দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। ফলে আমাদের দেশের অদক্ষ জনবল তাদের কাজ হারাচ্ছে। এশিয়া এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার কায়িক শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। বিদেশে বাংলাদেশি কায়িক শ্রমিকদের মজুরি গড়ে মাসিক ২০০ ডলারের সামান্য বেশি। ঠিক এ কাজেই ভারতীয়দের মজুরি ৪০০ ডলারেরও বেশি, চীনের প্রায় সাড়ে ৫০০ ডলার এবং ফিলিপিনোদের প্রায় ৬০০ ডলার।

উন্নয়নের গতিধারায় এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। আমাদের অর্থনীতি এখন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হচ্ছে; যার ফলে আমাদের কর্মদাতাদের একটা অভিযোগ হচ্ছে, আমাদের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষ করে কর্মদক্ষহীনভাবে কর্মজগতে আসে। আমরা বড়সংখ্যক সাধারণ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছি। কিন্তু অর্থনীতিতে এত বেশি গ্র্যাজুয়েট যুক্ত হতে পারছে না, টিকতে পারছে না। এটা শুধু চাকরির চ্যালেঞ্জ নয়, একই সঙ্গে সামাজিক চ্যালেঞ্জও। আমাদের দেশের শিল্প-কলকারখানায় দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাক খাতে ২০ শতাংশ দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে। আর এ সুযোগটি গ্রহণ করছে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো। তাদের কয়েক হাজার দক্ষ জনবল আমাদের তৈরি পোশাকশিল্পে কাজ করছে এবং তাদের উচ্চ বেতন দিতে হচ্ছে। অথচ আমাদের শ্রমিকরা বিদেশে খুব কম বেতনে কাজ করছে। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের ৬২ শতাংশ অদক্ষ, ৩৬ শতাংশ আধা দক্ষ এবং মাত্র ২ শতাংশ দক্ষ। এদের মধ্যে  উচ্চ মাধ্যমিক বা তদূর্ধ্ব পাস করেছে কমবেশি ১২ শতাংশ।

আমাদের দেশে প্রশিক্ষণকে সবচেয়ে অবহেলা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতাপূর্ণ শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে উৎপাদনশীলতা কমবেশি ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং এর প্রভাবে মজুরি বৃদ্ধি পায় দেড় শতাংশের মতো। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ শ্রমিকের সঙ্গে অদক্ষ শ্রমিকের উৎপাদনশীলতার পার্থক্য কমবেশি ৮ শতাংশের মতো। দেশে-বিদেশে সব জায়গায় এখন দক্ষ জনবলের চাহিদা বেশি। কোনো প্রতিষ্ঠানই অদক্ষ বা আধা দক্ষ জনশক্তিকে চাকরি দিতে চায় না। আমাদের তৈরি পোশাক খাতে যেমন  প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী শ্রমিকরা কাজ করছে এবং এ খাতে তাদের চাহিদাও আছে, তেমনি বিদেশে বিশেষ করে জর্ডান, মরিশাস, সিশেলস, কুয়েত, জাপান ও হংকংসহ বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, দেশে সবচেয়ে বেশি  প্রবাসী আয় এসেছে ঢাকা জেলায়। এরপর রয়েছেÑযথাক্রমে চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার অবস্থান। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছেÑলালমনিরহাট, রাঙামাটি, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও খাগড়াছড়িÑএই পাঁচ জেলা। এর মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় এসেছে লালমনিরহাটে, মাত্র ৫৬ লাখ ডলার। প্রবাসী আয়ে পিছিয়ে থাকা প্রায় প্রতিটি জেলা জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। আর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অন্যতম কৌশল হিসেবে অভিবাসনকে দেখা হয়। ফলে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীসহ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যারা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছেন, তারা এসব এলাকায় অভিবাসনে আগ্রহ বৃদ্ধি করতে তহবিল বৃদ্ধি,  প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া ও ভিসাপ্রক্রিয়া সহজীকরণের মতো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। এতে এসব এলাকা থেকে অভিবাসন বাড়বে। কমবে দারিদ্র্য, বাড়বে প্রবাসী আয়।

শ্রমিকদের মজুরি নির্ভর করে কাজের দক্ষতা ও দরকষাকষির সক্ষমতার ওপর। দরকষাকষির সক্ষমতা নির্ভর করে শিক্ষা,  প্রশিক্ষণ ও ভাষার দক্ষতার ওপর। সরকারের লক্ষ্য হলো দক্ষ এবং যোগ্যতাসম্পন্ন প্রজš§ গড়ে তোলা। এর মাধ্যমে শিক্ষা এবং কারিগরি জ্ঞান জগতে জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রমাগত বিকাশ এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করা।

পিআইডি নিবন্ধ