রেজাউল করিম খোকন:আগামী অর্থবছরের বাজেট আসছে। এখন চলছে বাজেট প্রণয়নের চূড়ান্ত কাজ। আগামী বাজেট নিয়ে এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে নানা গুঞ্জন। সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। টানা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বাজেট নিয়ে আলোচনা, আগ্রহ, সবার কৌতূহল থাকাটা স্বাভাবিক। নানা অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে গত বেশ কয়েকটি বছর পার করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার মুখ থুবড়ে পড়েনি। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলেন অনেকেই। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাবে, চরম বিপর্যয় নেমে আসবে, অভাব-দুর্ভিক্ষ-মন্দা গ্রাস করবে বাংলাদেশকে। এমন অনেক আশঙ্কার পর শেষ পর্যন্ত তেমন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেনি। এটাই আমাদের জন্য বিরাট প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে। এ জন্য পরপর একটানা চারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকারের কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হবে। এখনও আমাদের অর্থনীতি দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। নানা ধরনের আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা রয়েছে। তারপরও আমরা আশাবাদী। আগামী দিনগুলোতে আমাদের অর্থনীতি কোন দিকে এগোবে, তেমন কিছু চিন্তাভাবনার আলোকে আলোচনা করতে গেলে বলা যায়, অর্থনীতির অস্থিরতা দৃশ্যত কিছুটা কমলেও শঙ্কা কাটেনি। ডলারে দামের ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা আপাতত ঠেকানো গেছে। রিজার্ভের পতন কিছুটা সামাল দেয়া গেছে। আলোচিত ব্যাংক খাতের সমস্যাকে স্বীকার করে দেরিতে হলেও সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংক একীভূত করতে ভালো ব্যাংককে বাধ্য করা হচ্ছে। তবে খেলাপি ঋণ, স্বজনপ্রীতি, ব্যাংকমালিকদের অযাচিত হস্তক্ষেপÑব্যাংকের এ ধরনের চিরায়ত সমস্যাগুলো এখনও রয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি এখনও সাড়ে ৯ শতাংশের ওপরে আছে; যা সাধারণ মানুষকে ভোগাচ্ছে। শিগগিরই কমবে, সেই আশাও কম। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এখনও প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় কখনও বাড়ছে, কখনও কমছে। ডলার আসার অন্যতম প্রধান দুটি উৎস নিয়ে স্বস্তি আসেনি। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, সার্বিকভাবে অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত নয়; তবে সংকট থেকে উত্তরণ অর্থনীতিতে সংকট কেটে গেছে, তা বলা ভুল হবে। সংকট কাটার নির্ভরযোগ্য প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে না। কয়েক মাস আগেও নীতিনির্ধারকেরা সংকটকে স্বীকার করেছেন। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে যেন একধরনের তুষ্টি ফিরে এসেছে। সংকট থাকা অবস্থায় যদি তারা বলেন, সংকট নেইÑএটাই তো বড় সংকট। রপ্তানি আয় ছাড়া অন্য কোনো সূচকে সংকট কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রবাসী আয় বাড়লেও বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা নেই। তাই আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়ার মতো অবস্থাও নেই।
ব্যাংক খাতের অস্থিরতা কমছে না। ব্যাংক খাতের সমস্যার কথা স্বীকার করে গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক পথনকশা দিয়েছে। ইতোমধ্যে বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে চুক্তি করেছে। এছাড়া কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিডিবিএল এই চারটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশ্বব্যাংক এই ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সংস্থাটি বলছে, ব্যাংক একীভূত করায় সতর্ক থাকতে হবে। সম্পদের মান ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত। এ জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির মতে, ভালো ব্যাংক কখনও বাড়তি দায় নেয় না। অন্যদিকে ব্যাংক খাতের অন্য সমস্যা, যেমন স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতাশালীদের অনিয়ম, ব্যাংক পর্ষদে পরিবারের আধিপত্য, খেলাপি ঋণÑএসব কমানোর দৃশ্যমান বড় কোনো উদ্যোগ নেই। খেলাপি ঋণ ২০২৩ সালে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। গত ডিসেম্বর মাস শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশের মতো। ব্যাংক খাতে কিছুটা স্বস্তির বিষয়ও আছে। যেমনÑ‘নয়-ছয় পদ্ধতি’ বাতিল করে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সুদহার উš§ুক্ত করা হয়েছে। দেড় বছর ধরে ডলারের বাজার বেশ অস্থির ছিল। ৮৬ টাকার ডলার ১১০ টাকা হয়েছে। অনানুষ্ঠানিক দরও কিছুটা কমেছে। এখন ১১৭-১১৮ টাকার মধ্যে আছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, এক বছরের বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। এত দীর্ঘ সময় ধরে এত মূল্যস্ফীতি আগে দেখা যায়নি। মূল্যস্ফীতির চাপ সবচেয়ে বেশি পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর। বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাও শিগগিরই মূল্যস্ফীতির কমার সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। গত বছরের মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ হয়। পরে আর তা ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ হয়। গত আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সুদের হার বাড়িয়েছে। এখন ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার সাড়ে ১৩ শতাংশ হয়েছে। জুলাই মাসের পর থেকে ৯ শতাংশ থেকে সুদের হার বাড়ানো শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সুদের হার বাড়িয়ে সরকার বাজারের অর্থের প্রবাহ কমাতে চায়। এতে মানুষের হাতে টাকা কম যাবে, ফলে চাহিদাও কমবেÑএমন প্রত্যাশা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এতে অবশ্য বিপত্তিও আছে। দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) কমে যেতে পারে। বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়ার পরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়েছে, কিন্তু আমরা পারছি না। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি হয়েছে। কারণ, এ দেশের উৎপাদন খাতের প্রাথমিক ও কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। সেখানে খরচ বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তা, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ধরে রাখাসহ নানা কারণে রিজার্ভের বড় পতন আপাতত ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। ২০২৩ সালের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় ৩৪০০ কোটি ডলারের রিজার্ভ নিয়ে। এই হিসাব অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গতানুগতিক হিসাব পদ্ধতি। তখন রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি ছিল না। পরের এক বছরে রিজার্ভ শুধু কমেছে। সবচেয়ে বেশি কমেছিল ডিসেম্বর মাসে। আইএমএফের বিপিএম-৬ হিসাব পদ্ধতি অনুসারে ৭ ডিসেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৯১৩ কোটি ডলার। পরে তিন মাস রিজার্ভ ২ হাজার কোটি ডলারের আশপাশেই ছিল। সর্বশেষ ২৮ মার্চ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৪৫ কোটি ডলার। মূলত ডলার-সংকট, আন্তর্জাতিক বাজারের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিÑএসব কারণে আমদানি খরচ বেড়েছে। কিন্তু আমদানি খরচের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডলারের জোগান বাড়েনি। ফলে ক্ষয় হতে থাকে রিজার্ভের মজুত। তবে তিন মাস ধরে রিজার্ভের বড় ধরনের পতন হয়নি। রিজার্ভও সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই। কয়েক মাস ধরে ১৯-২০ বিলিয়ন ডলারে আটকে আছে রিজার্ভ। ব্যাংক খাতও নানা সমস্যায় জর্জরিত। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় কিছুটা ভালো। তবে সার্বিকভাবে অর্থনীতি বিপদগ্রস্ত নয়। কিন্তু অর্থনীতির চলমান সংকট থেকে উত্তরণ হয়নি। রপ্তানি খাতের পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো। গত চার মাসের রপ্তানি আয়ের সফলতায় চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অবশ্য এই রপ্তানি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ কম। শঙ্কার বিষয় হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো শ্রম আইন, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে নতুন নতুন শর্ত আরোপের কথা ভাবছে। ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত চাপের মুখে পড়তে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম পথ হলো বৈধ পথে প্রবাসী আয়। কিন্তু ডলারের দামের পার্থক্য বৈধ পথে ডলার আসায় গতি আনতে পারেনি। ডলার-সংকটের কারণে গত বছর ডলারের দাম নিয়ে নানা পরীক্ষা, বেশি দামে প্রবাসী আয় কেনা, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়াতে অতিরিক্ত প্রণোদনা প্রদানসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপরও বৈধ পথে প্রবাসী আয় কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি। এমনকি এই ঈদের মৌসুমে প্রবাসী আয় বাড়েনি। সর্বশেষ গত মার্চ মাসে প্রবাসীরা ১৯৯ কোটি ৬৮ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় ১৬ কোটি ডলার কম। বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েই চলেছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসেই (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ঋণ পরিশোধ ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময় ২০৩ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। গতবারের একই সময়ের ৪৩ শতাংশ বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে ৮০ কোটি ডলার হয়েছে। গত অর্থবছরে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। ঋণ পরিশোধ বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে ৩২ শতাংশ। মূলত চীন ও রাশিয়ার ঋণের কারণেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। এখন ঋণ করে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত ডিসেম্বরের শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণে স্থিতি ছিল ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৬৪ কোটি ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকার সমান। মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারি খাতে ৭৯ শতাংশ আর বেসরকারি খাতে ২১ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না এনবিআর। বড় ঘাটতির মুখে পড়তে যাচ্ছে এনবিআর। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) শুল্ক ও করসহ সব মিলিয়ে ১৮ হাজার ২২২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে। আইএমএফের শর্ত অনুসারে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশে সমপরিমাণ রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। এনবিআরকে এ বছরের লক্ষ্য দেয়া হয় ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পরে তা কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। আগামী বাজেটে আইএমএফের শর্তে কর ছাড় কমাতে হবে। এ জন্য অনেক খাতের কর মওকুফ ও রেয়াতি কর হার তুলে দিতে হবে। সার্বিক রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি এমন যে এখন উন্নয়ন বাজেটের পুরোটাই ধার করে বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। কাক্সিক্ষত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে খরচের জোগান দিতে পারছে না। চলতি অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাত্র ৩১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে আগামী বাজেটে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজার তদারকি বাড়াতে হবে। আবার খেলাপি ঋণ কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, খেলাপি ঋণ ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে ফেলে। সার্বিকভাবে মুদ্রাবাজার স্থিতিশীলতা আনতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরের তুলনায় অর্থমন্ত্রীর কাজ আরও ব্যাপক। হংকংভিত্তিক ফাইন্যান্স এশিয়া নামের একটি ম্যাগাজিন ভালো ও খারাপ অর্থমন্ত্রীদের তালিকা নিয়ে কাজ করত। তারা অর্থমন্ত্রীর কার্যক্রম বিচার করে কয়েকটি বিষয় ধরে। যেমন একজন অর্থমন্ত্রীর কাজ হচ্ছে বাজেট ও রাজস্ব নীতি ঠিকমতো তৈরি করা, পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করা, অর্থনীতির সংস্কার বাস্তবায়ন, আর বিশেষ করে কঠিন সময়ে বিনিয়োগকারীর আস্থা ধরে রাখা, যাতে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি ভালো থাকে। তবে অর্থমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে স্বাধীনভাবে কাজ করা। নিজের কাজ ঠিকঠাক করতে প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক দক্ষতা, নীতির ওপর কর্তৃত্ব, আমলাতন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারা এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষায় লড়াই করে যাওয়া। অথচ বেশির ভাগ অর্থমন্ত্রীর কাজই হচ্ছে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী অথবা সামরিক শাসককে তুষ্ট করা। বিপত্তি এখানেই। আর অর্থমন্ত্রী ও গভর্নর যদি দুজনেই নিকৃষ্ট হন, তাহলে কী হয়? তাহলে একটা দেশ শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হয়। সবার আগে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীদের একটা সাফল্যের কথা বলতেই হয়। বাজেট ঘাটতি প্রায় সব সময়েই সীমার মধ্যেই ছিল। এ নিয়ে খুব বেশি উচ্চাভিলাষী কেউই হননি। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাও বজায় রাখা গেছে। ঋণ পরিশোধে কখনও সমস্যায় পড়েনি বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধিও বেড়েছে। সব মিলিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। যদিও সেই সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গত তিন বছরে। অর্থমন্ত্রীদের ব্যর্থতার তালিকাও কম নয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০০৮ থেকে হওয়া সব আর্থিক কেলেঙ্কারির তথ্য দিয়ে বলেছে, এ সময় ঋণের নামে ৯২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০১০ সালে একটি বড় শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটেছে। ১৯৯৬ সালের পরে এটাই ছিল দেশের ব বৃহত্তম শেয়ার কেলেঙ্কারি। ব্যাংক খাত আরও নাজুক হয়েছে। সুশাসনের অভাব এখানে প্রচণ্ড। খেলাপিদের প্রতি অতি নমনীয় আচরণ এবং বারবার সুবিধা দেয়ায় খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তবে প্রকৃত খেলাপি আরও বেশি। অন্যদিকে কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ সর্বনিম্ন অবস্থানে থাকা দেশগুলোর একটি। সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে যেমন দেশের প্রায় সব অর্থমন্ত্রী নীতির ধারাবাহিকতা রেখেছেন, তেমনি ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেয়া, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের সুবিধা দেয়া, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ব্যাংকের অনুমোদনÑএসব নীতির ক্ষেত্রেও অর্থমন্ত্রীরা ছিলেন উদাহরণ দেয়ার মতো ধারাবাহিক। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার প্রায় দুই বছর হলো গভর্নর পদে আছেন। তবে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল হাসান মাহমুদ আলী অপেক্ষাকৃত নতুন। অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগে পাঁচ বছর তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। এই পাঁচ বছরে তিনি কমিটির ১৪টির মতো বৈঠক করেছেন। যদিও প্রতি মাসে অন্তত একটা করে বৈঠক করার নিয়ম রয়েছে। আবার সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শেষ তিন বছরে নিয়মিত কার্যালয়েও আসতেন না। এখন আবার তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় যে অর্থমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রধান কাজ হবে সেটাও প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তা কতটা সম্ভব হবে, সেটাও এক বড় প্রশ্ন।
এদিকে আগামী অর্থবছরের নতুন বাজেটের প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। চাপ কিছু কমলেও অর্থনীতি উত্তরণের পর্যায়ে যায়নি। জুনে যেমন নতুন বাজেট দেবেন নতুন অর্থমন্ত্রী, তেমনি নতুন মুদ্রানীতির ঘোষণা দিতে হবে গভর্নরকেও। দুই নীতির সমন্বয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করার এটাই সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ, সাধারণ মানুষ বাজারে স্বস্তি চায়। একই সঙ্গে কমাতে হবে ব্যাংক খাতের অস্থিরতাও। এখানে ব্যাংক খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেয়া হয়। সুদহার কমানো, নতুন ব্যাংক দেয়া থেকে শুরু করে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্তÑসবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ থেকেও পরিত্রাণ দরকার। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। দূর করতে হবে বিনিয়োগের মন্দাভাব। বাড়াতে হবে রিজার্ভ। ডলার-সংকটেরও অবসান দরকার। সব মিলিয়ে দেশের অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের জন্য সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ওপরেই নির্ভর করছে ইতিহাসে কার স্থান কোথায় হবে। কে ভালো কে খারাপ, তারও ফয়সালা হবে। অন্তত বিশ্বের অন্যান্য দেশেই অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরকে এভাবেই মূল্যায়ন করা হয়। আমরাও এভাবে মূল্যায়ন করতে চাই। একই সঙ্গে কমাতে হবে ব্যাংক খাতের অস্থিরতাও। এখানে ব্যাংক খাতের অধিকাংশ সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নেয়া হয়। সুদহার কমানো, নতুন ব্যাংক দেয়া থেকে শুরু করে ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত-সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ থেকেও পরিত্রাণ দরকার। বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। দূর করতে হবে বিনিয়োগের মন্দাভাব। বাড়াতে হবে রিজার্ভ। ডলার-সংকটেরও অবসান দরকার।
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক