রহমত রহমান ও রোহান রাজিব: ২০২১-২২ অর্থবছরে জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ভ্যাট প্রদানের জন্য ৪৮০ প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের তথ্য যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে তালিকা দেয়া হয়। তালিকা যাচাইয়ে দেখা গেছে, ৪২৭টি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি থেকে মুক্ত ছিল। বাকি ৫৩টি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও পরিচালকরা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
৫৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টি প্রতিষ্ঠানও ঋণখেলাপি ছিল। এনবিআরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর (সিআইবি) পাঠানো এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনের কপি শেয়ার বিজের হাতে রয়েছে।
জানা গেছে, ৫৩টি প্রতিষ্ঠানের যেসব ব্যক্তি ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, এর মধ্যে কেউ তার অন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপি। আবার অনেকে ক্রেডিট কার্ডের কারণে ঋণখেলাপি, একজনের নামের তথ্য আরেকজনের নামে চলে আসায় ঋণখেলাপি ও জামিনদাতা হিসেবেও খেলাপি রয়েছে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৫৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি। পাশাপাশি এর মালিক ও পরিচালকরাও ঋণখেলাপি। বাকি ৩৬টি প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি না হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও পরিচালকরা ঋণখেলাপি।
ঋণখেলাপি ১৭ প্রতিষ্ঠান, মালিক ও পরিচালক
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কিংস কনফেকশনারী (বাংলাদেশ) পিটিই লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটি ঋণখেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মো. শামীম মিয়া জামিনদাতা হিসেবে এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কারণে ঋণখেলাপি। রাজমহল ফুডস অ্যান্ড সুইটস ইন্ডাস্ট্রিও ঋণখেলাপি; প্রতিষ্ঠানটির মির্জা মো. বেলাল আহমেদ স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের কারণে ঋণখেলাপি। সায়হাম মাল্টি ফাইবার টেক্সটাইলস লিমিটেড ঋণখেলাপি; প্রতিষ্ঠানটির কাশফিয়া নেহরীণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কারণে ঋণখেলাপি। ওয়েল ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি লিমিটেড ঋণখেলাপি; প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কারণে ঋণখেলাপি। নর্দান এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল কো. লিমিটেড ঋণখেলাপি। ওসমান অটো ব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ঋণখেলাপি; এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মো. ওসমান শেখ স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের কারণে ঋণখেলাপি। গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ঋণখেলাপি; এর পরিচালক মামুনুর রশিদ করিণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঋণ খেলাপি। নেক্সট ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ঋণখেলাপি; প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মারুফ সাত্তার আলী স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কারণে ঋণখেলাপি। ইন্ট্রা স্ন্যাক্স অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডা. লিমিটেড ঋণখেলাপি; এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মোহাম্মদ আজাদ খান স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপি। এস কে মোটরস প্রতিষ্ঠানটিসহ এর পরিচালক মো. সাব্বির হোসেন ঋণখেলাপি। আর আর স্পিনিং অ্যান্ড কটন মিলস লিমিটেড প্রতিষ্ঠানটিও ঋণখেলাপি; প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নাবিলা আফজাল স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কারণে ঋণখেলাপি। এছাড়া ইন্টারফোল্ড ট্রেডিং, চয়না বাংলা ফুডস প্রতিষ্ঠানটিসহ এর মালিক একেএম আনিছুর রহমান, মেসার্স আসফাকুল আলম চৌধুরী প্রতিষ্ঠানটিসহ এর মালিক আসফাকুল আলম চৌধুরী, ইসলামি পচুর হোটেল প্রতিষ্ঠানটিসহ এর মালিক মো. শরিফুল ইসলাম এবং মেসার্স পলি প্লাইউড প্রতিষ্ঠানটিসহ এর মালিক মো. মহিব উল্যাহ ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
৩৬ প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি নয়; মালিক ও পরিচালক ঋণখেলাপি
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ফুট স্টেপ বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম, হেরিটেজ রিসোর্ট লিমিটেডের পরিচালক মেনহাজুর রহমান, আলম মেরিন শীপ বিল্ডার্স লিমিটেডের পরিচালক মো. আলম খান, নিটল কার্টিজ পেপার মিলস লিমিটেডের পরিচালক
আব্দুল মাতলুব আহমেদ, হাইওয়ে ইন লিমিটেডের পরিচালক সৈয়দ একেএম সেলিম, মারিশিপা আউটফিটার্সের পার্টনার আবুল মাসুদ চৌধুরী, মেসার্স নোভা বাজাজের মালিক মো. আমিনুল ইসলাম, রংপুর ট্রেডার্সের মালিক মো. জসিম উদ্দিন, মেসার্স রেজিয়া সেপ ফ্যাক্টরির মালিক মো. মিজানুর রহমান, আরফাত ট্রেডিংয়ের মালিক খালিদ হোসেন সাজ্জাদ, মেসার্স রত্না ট্রেডার্সের মালিক শ্যামল কুমার বণিক, হোটেল এরিনা (প্রা.) লিমিটেডের পরিচালক শফিকুল আলম গুলজার, ওয়েস্টার্ন মটরসের পরিচালক মো. তাজ রহমান টনী, ক্যামিও প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মো. আবদুর রশিদ, আরাফাত অটোর মালিক আরাফাত হোসেন, হাসান পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলস লিমিটেডের পরিচালক এটিএম শাফিকুল হাসান (জুয়েল), দেশবন্ধু সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের পরিচালক গোলাম রহমান, অ্যারিস্ট্রোক্রেট রেস্টুরেটের মালিক মো. আতিকুজ্জমান খান এবং প্রাইম ডিস্ট্রিবিউশনের মালিক জাহেদুল ইসলাম ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশ জামিনদাতা হিসেবে ও তার স্বার্থসংশিস্নষ্ট ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের কারণে ঋণখেলাপি।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, কিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক ও পরিচালকরা ক্রেডিট কার্ডের কারণে ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে হোটেল সুগন্ধা অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের মালিক মো. সাহাদাত হোসেন, মেসার্স হিমালয় অটো ব্রিকসের মালিক মো. রাহিনুর ইসলাম, সৃজনী ট্রেড সেন্টারের পরিচালক এম হারুন আর রশিদ, তামিম এন্টারপ্রাইজের মালিক এম হারুন-আর রশিদ এবং পা-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের পরিচালক এস আম মাহাবুব আলম ক্রেডিট কার্ডের কারণে ঋণখেলাপি।
অন্যদিকে এসসি জনসন প্রাইভেট লিমিটেড, জিয়াংসু জিনডিং স্টোরেজ কোং লিমিটেড, হোটেল পশুর, হোটেল অভি, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং সুপার স্টার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড ঋণখেলাপি মুক্ত। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান এসসি জনসন প্রাইভেট লিমিটেড ও জিয়াংসু জিনডিং স্টোরেজ কোং লিমিটেডের পরিচালক যথাক্রমে আরোরা মানু ও ইয়াং লিয়ানলিয়ান তদন্ত ফর্ম অনুযায়ী ব্যক্তিগত তথ্য না পাঠানোর কারণে তার ঋণতথ্য যাচাই করতে পারেনি সিআইবি। এছাড়া হোটেল পশুরের পরিবর্তে তদন্ত ফর্মে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের প্রতিষ্ঠানের তথ্য দেয়া হয়েছে। হোটেল অভি’র স্বত্বাধিকার কাজী নুরুল হুদার তথ্যের পরিবর্তে তদন্ত ফর্মে নিলুফার ইয়াসমিনের তথ্য দেয়া হয়। অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিচালক মোবারক আলীর তথ্যের পরিবর্তে মো. নাজিমউদ্দিনের তথ্য রয়েছে। আর সুপার স্টার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড পরিচালক মো. হারুন-আর-রশিদের পরিবর্তে মো. ইব্রাহিমের তথ্য ছিল।
ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, ৫৩টি প্রতিষ্ঠানের মালিক বা পরিচালকরা তার অন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপি হয়, তাহলে ওইসব প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারবে না। যদি ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি না হয়, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এনওসি পাওয়ার শর্তে ঋণ পাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিটল কার্টিজ পেপার মিলসের পরিচালক ও এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি কোনো জায়গায় ঋণখেলাপি নেই। ২০১৪ সালে একটি লিজিং কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলাম। তখন সব ঠিক ছিল। পরে তারা খেলাপি হয়। তবে বেশিরভাগ ব্যাংক ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে। তবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ইচ্ছে করে খেলাপি করে রেখেছে, যখন লিজিং প্রতিষ্ঠানটি খারাপ হয়েছিল।’