ওয়াসিফ জামান। মিকা সিকিউরিটিজের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বর্তমানে ঢাকায় তাদের ১০টি শাখা রয়েছে। তিনি ১০ বছর ধরে পুঁজিবাজারে কাজ করছেন। পুঁজিবাজার নিয়ে আমেরিকার সানফ্রানসিসকোর হাল্ট ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস স্কুল থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। কাজ করেছেন সিলিকন ভ্যালির ওয়েলস ফার্গো ব্যাংকে। পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সম্প্রতি শেয়ার বিজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ্যারিয়ান স্ট্যালিন
শেয়ার বিজ: আমাদের দেশে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা কতটুকু জেনে-বুঝে আসেন?
ওয়াসিফ জামান: বাজার সম্পর্কে অনেকেরই তেমন কোনো ধারণা নেই। তবে কম সময়ে কীভাবে লাভবান হওয়া যায়, সে চিন্তা নিয়েই অনেকে আসেন। অথচ বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে ন্যূনতম দিকনির্দেশনা পান না। এ কারণে তাদের বিনিয়োগ নষ্ট হয়। দেশের বাইরে আমেরিকার মতো মার্কেটেও একই অবস্থা দেখেছি। সেখানেও বিনিয়োগকারীরা ভালোভাবে না বুঝেই বাজারে চলে আসেন। ওখানে কেউ বিনিয়োগ করতে এলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার সম্পর্কে জানা-বোঝার জন্য তাদের একজন পেশাদার পরামর্শকের সামনে বসিয়ে দেয়। ওই পরামর্শকরা পেশাদার; তারা সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই কাজ করেন। সেখানে লাইসেন্স পেতে তাদের পরীক্ষা দিতে হয়। বাজার সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা রাখেন পরামর্শকরা। একজন বিনিয়োগকারীকে কতখানি দিকনির্দেশনা দিতে হয়, সেটা তারা জানেন। বিনিয়োগ করা অর্থ যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য তারা সঠিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন। বিনিয়োগকারীর পুঁজির আকার ও নিরাপত্তার দিকটি মাথায় রেখে ওই বিনিয়োগ উপদেষ্টারা একটি ব্যালেন্স পোর্টফোলিও তৈরি করে দেন।
শেয়ার বিজ: নতুন বিনিয়োগকারীর জন্য আপনারা কি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন? কীভাবে গাইড করছেন?
ওয়াসিফ জামান: আমি অ্যাসেস করার জন্য তাদের দুটো প্রশ্ন করে থাকি। তাদের একটি চার্ট দিই। সঙ্গে কিছু প্রশ্নও করি। যেমন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কী, আপনি কী করতে চাচ্ছেন, আপনার লক্ষ্য কী? এছাড়া আমার টিমকে বিনিয়োগকারীদের সম্পর্কে জানতে বলি। শুরুতে বিনিয়োগকারীর মূল লক্ষ্য বোঝার চেষ্টা করি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাদের কোনো লক্ষ্য বা পরিকল্পনা নেই। তারা শুধু বিনিয়োগ করবেন বলেই বাজারে এসেছেন।
আমি মনে করি, একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকা উচিত। সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সঠিক পরিকল্পনা থাকা দরকার। তবেই তারা সফল হতে পারবেন। ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা আর বাজার সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণাও থাকতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠানের কয়েক বছরের আয়-ব্যয়, বিনিয়োগ-মুনাফা ও লাভ-লোকসানের তথ্য-উপাত্ত ইত্যাদি খুঁটিয়ে দেখার মানসিকতা থাকতে হবে।
বাংলাদেশে অনেক শেয়ার আছে, যেগুলোর দর সব সময়ই একটি সন্তোষজনক অবস্থানে থাকে। বিনিয়োগকারী সেখানে বিনিয়োগ করে মুনাফা করেন। কোম্পানি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হয়। বাজার ভালো-খারাপ যাই হোক না কেন, তখন মুনাফা করা সম্ভব।
শেয়ার বিজ: ২০১০ সালের ধস সম্পর্কে কিছু বলুন। কেন তখন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন বিনিয়োগকারীরা?
ওয়াসিফ জামান: আমি মনে করি, অলস অর্থ নিয়ে সবারই বাজারে আসা উচিত। মানে, চাহিদার অর্থ রেখে বাকিটা বিনিয়োগ করা উচিত। আমরা ব্যাংকে যে টাকা রেখে দেই, সেটাও অলস। আর পুঁজিবাজারে আসতে চাইলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো বুঝতে হবে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। পতন সব মার্কেটেই হয়। উন্নত বিশ্বের মার্কেটগুলোতেও এমন ঘটতে দেখেছি। ২০১০-এ ধসের সময় দেখেছি, তখন গুণগত মানসম্পন্ন শেয়ার সাপ্লাই ছিল আমাদের পুঁজিবাজারে। বিনিয়োগের পরিমাণ খুব বেশি হয়েছিল তখন। ফলে প্রায় সব শেয়ারের দাম বার্বল হয়ে এক্সেস উঁচু দরে চলে যায়। ফলে ধস নামে বাজারে।
তাই বিনিয়োগকারীদের আবারও বলতে চাই, কোম্পানির কয়েক বছরের তথ্য-উপাত্ত জেনে ও বুঝে বিনিয়োগ করুন। প্রয়োজনীয় টাকা রেখে অলস অর্থই বিনিয়োগ করবেন।
শেয়ার বিজ: অন্য দেশের পুঁজিবাজারের সঙ্গে আমাদের দেশের পার্থক্য কোথায়?
ওয়াসিফ জামান: আমেরিকার কথাই বলি। বাইরে পুঁজিবাজারের প্রায় সব টাকাই পেশাদারিত্বের সঙ্গে ম্যানেজ করা হয়। এ প্রফেশনাল ম্যানেজ বলতে মার্কেটে প্রচুর মিউচুয়াল ফান্ড থাকাকে বুঝিয়েছি। আমি আমেরিকায় অনেক ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেল করতাম, তারা অলস টাকাটাই নিয়ে আসতেন পুঁজিবাজারে।
বিদেশে একেকজন বিনিয়োগকারীর সামনে ৪০টি মিউচুয়াল ফান্ড রাখা হয়। সেখানে থেকে তিনি ১০টি বেছে নিতে পারবেন। তাদের সঙ্গে একজন অর্থনৈতিক উপদেষ্টাও থাকেন। উপদেষ্টারা ঝুঁকি অনুযায়ী একটি পোর্টফোলিও তৈরি করেন। এ কারণে মার্কেটে উত্থান-পতন হলে পোর্টফোলিওর জন্য খুব একটা ক্ষতির মুখে পড়েন না বিনিয়োগকারীরা। এমন কি ভারতেও একই অবস্থা। অথচ এ বিষয়টিই আমাদের দেশে অনুপস্থিত।
আমাদের দেশে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো প্রফেশনালি ম্যানেজ করা হলে বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হবেন।
শেয়ার বিজ: বর্তমান বাজারে বিনিয়োগকারীদের টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?
ওয়াসিফ জামান: গত অক্টোবর থেকে মার্কেট ভালো চলছে। তবে যারা এফডিআর করেছেন, তারা ভালোই লভ্যাংশ পেয়েছেন। অনেকে দু’তিনগুণ বেশিও পেয়েছেন। তবে আমি তাদের লক্ষ্যটাকেই প্রাধান্য দিতে চাই। আমি তাদের অনেককে বুঝিয়েছি পাঁচ কিংবা ছয়গুণ লভ্যাংশ নয়। এফডিআরের চেয়ে তিন-চারগুণ পেলেই তাকে সফলতা বলে ধরে নেওয়া উচিত। এরপর যা আসবে, সেটা বাড়তি।
শেয়ার বিজ: অভিজ্ঞতা থেকে পুঁজিবাজারের ভেতরের গল্পটা বলুন…
ওয়াসিফ জামান: আমার সঙ্গে সিলিকন ভ্যালির দুটি কোম্পানি কাজ করতো। বছরখানেক ব্যবসা করার পর তারা অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে চলে যায়। আমরা যেমন একটা পোর্টফোলিওতে ১০টি শেয়ার কিনি, বিদেশিরা কিন্তু ১০টি মার্কেটে বিনিয়োগ করেন। ওটা দিয়েই তারা যাচাই-বাছাই করে। যে মার্কেট ভালো, সেখানে তারা বিনিয়োগ করে। আমাদের দেশে মার্কেট রেট, প্রডাক্ট ও অধিগ্রহণ একীভূত অন্যান্য দেশ থেকে ভিন্ন। যেমন আমেরিকা, ইউরোপ বা ভারতে তাড়াতাড়ি শেয়ার ম্যাচিউর হয়ে যায়। এখানে যেমন দুদিন পর বিক্রি করতে পারবেন। আমরা দেখতে চাই হ্যাজিং করা যায় কিনা! হেজিং হলো এমন একটি ব্যাপার, ওরা একই মার্কেেট কিছু প্রডাক্ট বের করে। কোন কোন পণ্যের দাম বাড়লো বা কোন সাইটটা বাড়লো, ভবিষ্যতে অন্য কোন কোন প্রডাক্টের দাম কমবেÑতার একটি তালিকা করে। বলতে পারেন বিশ্লেষণ। তো ওরা ওইভাবে কিছু পণ্য কিনে রাখে। যেটা ওদের খারাপ সময়েও সাহায্য করে।
শেয়ার বিজ: কোম্পানি লোকসানে থাকার পরও বাজারে শেয়ারের দাম বাড়ে কেন?
ওয়াসিফ জামান: স্টক মার্কেটের একটি বিশ্বরূপ রয়েছে। প্রায় সব জিনিস নিয়েই রিসার্চ করেছি। দেখে থাকবেন, অনেক শেয়ার এখন লসে আছে অথচ দাম বেড়ে গেছে। লাফার্জের ক্ষেত্রে দেখে থাকবেন কোম্পানি আর্থিক ক্ষতিতে ছিল। লসে থাকা অবস্থায় তাদের দাম বাড়তে শুরু করে। এখন প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন ক্ষমতা চারগুণ। আর দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ। তাছাড়া বাংলাদেশে যেভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, নানা প্রজেক্ট সম্পন্ন হচ্ছেÑএটা আগে কখনও হয়নি। এ কারণেই দাম বেড়ে যাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানিগুলো থেকে লাভবান হবে।
শেয়ার বিজ: পুঁজিবাজারে সরকারের নজরদারি কেমন?
ওয়াসিফ জামান: গত তিন-চার বছরে সরকার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। ধসের পর কিছু রিফর্ম করেছে। ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা পৃথককরণ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এটা সরকারের একটি বড় অবদান। মার্জিন লোন রেশিও কমিয়ে দিয়েছে, এটাও ভালো একটি কাজ। এক্সপোজার পোর্টফোলিও অনেক কমে গেছে। আগে এক্সপোজার ঝুঁকি বেশি ছিল। যেমন এক লাখ টাকার ক্ষেত্রে এক লাখ টাকা লোন দিয়েছিল। তখন ক্ষতি বেশি হতো। শেয়ারদর ১০ শতাংশ কমলে তার ২০ শতাংশ ক্ষতি হতো। দ্বিগুণ ক্ষতি হতো সব ক্ষেত্রে।
বর্তমানে দেশের অবস্থা স্থিতিশীল। এটা পুঁজিবাজারের জন্যও ভালো। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আগে বিদেশি এফডিআর কমে গিয়েছিল। এখন সে অবস্থা নেই। পরিস্থিতি পুঁজিবাজারের অনুকূলে। একই সঙ্গে সরকারের বড় বহুমুখী প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিনিয়োগকারীই লাভবান হবেন। ব্যাংক, সিমেন্ট, স্টিল প্রভৃতি খাতের সবাই লাভবান হচ্ছেন।
শেয়ার বিজ: নতুনদের জন্য আপনার পরামর্শ…
ওয়াসিফ জামান: নতুনরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আগে পড়াশোনার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ নিয়েই যেন মার্কেটে আসেন। ঝোঁকের মাথায়, কারও কথায় বিনিয়োগ করলে লাভের বদলে লোকসানই হবে। আর একটি কথা মাথায় রাখতে হবে, তারা জেন গুজবে কান না দেন। গুজব সব মার্কেটেই আছে। নতুন বিনিয়োগকারীদের বলবো, গুজবকেই প্রশ্ন করুন। দামটা কেন বাড়ছে? কারণ জানার চেষ্টা করুন। বোঝার চেষ্টা করুন। কোম্পানি ও খাত সম্পর্কে প্রতিদিনের প্রকাশিত তথ্যউপাত্ত যাচাই-বাছাই করুন। সব মার্কেটেই ভালো-খারাপ আছে। যাদের লভ্যাংশের ধরন সব সময় ভালো থাকে, যারা নগদ লভ্যাংশ দেয়, স্বনামখ্যাত দেশি ও বহুজাতিক যেসব প্রতিষ্ঠান বাজারে আছে, সেসব শেয়ার কিনতে বলবো নতুনদের।
Add Comment