পলাশ শরিফ: কোনো কোম্পানিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে তার সুনাম বাড়ে। আর এ সুনামের কারণে কোম্পানি এগিয়ে যায়। আর কোম্পানিটি যদি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত থাকে, তাহলে প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের চাহিদা থাকে আকাশছোঁয়া। ফলে বাড়ে শেয়ারদর, বাড়ে বাজার মূলধন। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সুনামকে কাজে লাগিয়ে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের বাজার মূলধন পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় পুঁজিবাজারে বড় ধরনের অবস্থান তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিশ্লেষকদের মতে, পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সঠিক ব্যবহার করলে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের মতো অবস্থান তৈরি করা যায়। এজন্য দরকার সৎ মানসিকতা, বড় মন ও সুশাসন। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ কোম্পানির এটি নেই। তারা বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে বিদেশে পাচার করে, অন্য খাতে ব্যয় করে। ফলে ওই কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুঁজিবাজারের বেশিরভাগ কোম্পানির হিসাব-নিকাশ সঠিক নয়। ঠিকমতো লভ্যাংশ দেয় না। নেই কোনো সুশাসন। এ কারণে তাদের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। ফলে তাদেও শেয়ারের দর তলানিতে থাকে। বাজার মূলধনও কম থাকে। কিন্তু অল্প কিছু কোম্পানি এর ব্যতিক্রম। অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ তার মধ্যে অন্যতম।
স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা, করপোরেট সুশাসন আর সময়োপযোগী পরিকল্পনার ওপর ভর করে শক্ত ভিত গড়েছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ। বিস্কুট উৎপাদনকারী হিসেবে দেশে-বিদেশে সুনাম করেছে। দুই দশকে আয়-মুনাফায় উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির কারণে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের কাছে আস্থার নাম হয়ে উঠেছে ‘অলিম্পিক’। প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন ২০০ কোটি টাকা হলেও বাজার মূলধন পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কোম্পানিটির রিজার্ভও প্রায় ২৫৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
আলাপকালে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের নির্বাহী পরিচালক ও কোম্পানি সচিব মো. নাজিমউদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সময়োপযোগী পরিকল্পনা, উন্নত প্রযুক্তি আর ক্রেতাদের আস্থাই আমাদের মূল চালিকাশক্তি। এখানে ব্যবসার ক্ষেত্রে ক্রেতা, বিনিয়োগকারী ও দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এছাড়া সময়োপযোগী ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত, পণ্যের গুণগত মান ও বৈচিত্র্যতাও এগিয়ে চলায় ভ‚মিকা রাখছে। আমরা এখন বিদেশেও পণ্য রফতানি করছি। বাড়তি চাহিদার কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে হচ্ছে। সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে কোম্পানিকে এগিয়ে রাখতেই কাজ করে যাচ্ছি।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৭৯ সালে ব্যাটারি প্রস্তুতকারক কোম্পানি হিসেবে ‘বেঙ্গল কার্বাইড কোম্পানি’ নামে নিবন্ধন নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ১৯৮২ সালে এসে বাণিজ্যিকভাবে ব্যাটারি উৎপাদন শুরু করে। ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাটারির পাশাপাশি খাদ্যপণ্য (সয়াবিন তেল ও ঘি) উৎপাদন শুরু করে কোম্পানিটি। ১৯৯১ সালে পাম অয়েলের মাধ্যমে খাদ্যপণ্য উৎপাদন শুরু করে। ব্যাটারি ও খাদ্যপণ্য নিয়ে নব্বইয়ের দশকের মাঝ পর্যন্ত সফলভাবে ব্যবসা করে কোম্পানিটি।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১১-১২ আর্থিক বছরে ৪২ হাজার ৪২৩ মেট্রিক টন বিস্কুট উৎপাদন করেছিল অলিম্পিক, যা ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে এসে ৮০ হাজার ১৫৭ মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে উৎপাদন প্রায় ৮৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর জের ধরে পাঁচ বছরে কর-পরবর্তী মুনাফা প্রায় ১৫০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১২ সালে ৪৬ কোটি ৫২ লাখ টাকার বিপরীতে ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে ১৬২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা কর-পরবর্তী মুনাফা করেছে অলিম্পিক। আর আয়-মুনাফায় প্রবৃদ্ধির কারণে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য হারে লভ্যাংশ দিচ্ছে অলিম্পিক। সর্বশেষ আর্থিক বছরেও বিনিয়োগকারীদের ৪০ শতাংশ নগদ ও পাঁচ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। সর্বশেষ চলতি (২০১৬-১৭) আর্থিক বছরের তৃতীয় প্রান্তিক শেষে কোম্পানিটির পরিচালন মুনাফা দাঁড়িয়েছে ১২৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এ সময়ে কোম্পানিটির টার্নওভার ছিল প্রায় ৮৪৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
পথচলার আটত্রিশ বছরে ব্যবসা সম্প্রসারণ, নতুন নতুন পণ্য সংযোজনের দিকে সব সময়েই মনোযোগ দিয়েছে অলিম্পিকের। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে বিস্কুট উৎপাদন শুরুর পর থেকে ১১ বছরে আট দফায় কারখানার সম্প্রসারণ করেছে। গত এক বছরে ব্যবসা সম্প্রসারণে নতুন করে প্রায় ৭০ কোটি ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৬ সালে ভারত ও ইতালি থেকে নতুন ‘বিস্কুট ও কুকিজ লাইন’ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় অলিম্পিক। নতুন ইউনিট স্থাপনে বিদেশ থেকে আরও যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে কোম্পানিটি। নারায়ণগঞ্জের মদনপুরের কারখানায় নতুন ওই কুকিজ ইউনিটে চলতি বছরের মে মাসে বাণিজ্যিকভাবে বিস্কুট উৎপাদন শুরু হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে ডিএসইতে ও ১৯৯৬ সালে সিএসইতে তালিকাভুক্ত হয় অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ। ব্যবসায়িক সুনাম ও স্বচ্ছতার কারণে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে স্থান করে নেয়। তাই সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহও বাড়ছে। ডিএসইতে অলিম্পিকের ১০ টাকা ফেসভ্যালুর প্রতিটি শেয়ার সর্বশেষ ২৭০ টাকা দরে লেনদেন হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ বর্তমানে কোম্পানিটির মোট ১৯ কোটি ৯৯ লাখ শেয়ারের মধ্যে ৪২ দশমিক ৩১ শতাংশই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে। এছাড়া উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে ২৮ দশমিক ৯২ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৬ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ শেয়ার রয়েছে।