প্রথমে খাদ্যমন্ত্রী, পরে বাণিজ্যমন্ত্রী এবং সবশেষে প্রধানমন্ত্রী যখন চালের উচ্চমূল্য নিয়ে কথা বলেন, তখন বিষয়টিকে আর হেলাফেলা করা যায় না। হেলাফেলা করা যায় না, তার আরও কারণ হতভাগা এ দেশে চালের দাম শুধু নয়, যে কোনো পণ্যের দাম বাজারে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা হলে মিডিয়ায় আসতে আসতে তা ৮০ টাকা হয়ে যায়। মূল্যবৃদ্ধির সময়ে দাম বাড়ে মুখে মুখে। মূল্যহ্রাসে কিন্তু তা হয় না। আমার মনে হয়, চাল নিয়ে এবার এমনটাই ঘটছে। হয়তো সমস্যা কিছুটা আছে। কোথাও কোথাও হয়তো অপরিকল্পনা, গাফিলতিও আছে। কিন্তু তা সংকটাবস্থা তৈরির মতো নয়। তবু বর্তমান পরিস্থিতিটা এ মুহূর্তে বেশ কিছুটা অস্থিতিশীল। বলা বাহুল্য, অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধির এ মুহূর্তের কারণ তিনটি। ঈদের ছুটি। কোরবানির ঈদে প্রতিবছরই ছুটি প্রলম্বিত হয়। যোগাযোগ ও সরবরাহ কিছুদিন স্থগিত থাকে। তা থাকে এমনকি বেনাপোল ও রাজশাহী সীমান্তেÑযেখান দিয়ে চাল আসে ভারত থেকে। দ্বিতীয় কারণ, একটি ভিত্তিহীন কাহিনি, গুজব। একটা অপশক্তি গুজব ছড়ায়Ñভারত চাল রফতানি করবে না, অথচ ভারত আমাদের চাল আমদানির অন্যতম উৎস। বলা হয় মিয়ানমারের কথা। রোহিঙ্গা সমস্যার সঙ্গে সঙ্গেই একটা মহল কথা তোলে যে, মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি করা ঠিক হবে নাÑকারণ তারা রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। তারা এ কথাটা ভাবলই না যে, বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সমস্যা আজকাল পৃথক। অধিকন্তু পাঁচ-ছয় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে, যাদের জন্য চাল লাগবে। এমনিতেই আমাদের চালের টানাটানি, তার ওপর রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণÑএটা কীভাবে সম্ভব। অধিকতর চাল লাগবে, তার মানে অধিকতর চাহিদা। একশ্রেণির ব্যবসায়ী এটাকে সুযোগ হিসেবে দেখে। তারা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে। এটা চোখের সামনের ঘটনা। অথচ উদ্বেগজনক ঘটনা। সরকার চাল ব্যবসায়ী, চাতালের মালিক, পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে অনুরোধ জানায়। বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। দু-এক জায়গায় প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নেয়। কিন্তু মনে হচ্ছে, এ ব্যবস্থা কাজে আসেনি বা আসছে না। বস্তুত তা আসবেও না। অভিজ্ঞতা বলে, ব্যবসায়ীরা সংকট তৈরি করে, তারা সংকটে সরকারের সাহায্যে আসেন না। গত ‘কেয়ারটেকার’ সরকারের আমলে যে চাল সংকট হয়, যখন আলু খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে গান লেখা হয়েছিল, তখনও ব্যবসায়ীরা সরকারের কথা শোনেননি। হুমকি-ধমকি দিয়েও কাজ হয়নি। রোজার আগেও তা হয় না। আমাদের দেশের চাল ব্যবসায়ীরা ‘দেশপ্রেমিক’। তারা কোনো সুযোগই হাতছাড়া করেন না। এমতাবস্থায় একটাই করণীয়Ñযেকোনোভাবে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানো। বাজারকে বাজারের মতোই কাজ করতে দিতে হবে। এটা চাহিদা ও সরবরাহের বিষয়। ডর-ধমকের বিষয় নয়। রাস্তাঘাটে, ট্রাকে, দোকানে যদি সরকারি চাল থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীদের কারসাজি করার ক্ষমতা থাকবে না। এ কথা ঠিক, বোরো ফসল উঠেছে। যে আউশ ফসল ইতোমধ্যে উঠেছে, তা মানুষ খেয়ে শেষ করে ফেলেনি। অনেকের ঘরে চাল আছে। কিন্তু ওই চাল হিসাবে নিয়ে বাজার স্বাভাবিক হবে, এ চিন্তা করাটা ঠিক হবে না। এখন আশ্বিন মাস, সামনে ‘মরা কার্তিক’। তারপর অগ্রহায়ণ ও পৌষ। তখন আমন উঠবে। এটা বড় ফসল নয়। বড় ফসল বোরো, যা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে উঠবে। বলা যায়, হিসাবটা হবে ওই সময় পর্যন্ত। বেশ লম্বা সময়। এতটা দীর্ঘ সময় বাজারে সরকারকে সক্রিয় থাকতে হবে। প্রমাণ করতে হবে সরকারের হতে প্রচুর খাদ্যশস্য আছে। অভাব হবে না খাদ্যশস্যের। প্রায় ৫০ লাখ হতদরিদ্রকে ১০ টাকা কেজিতে চাল দিতে হবে। শহরে কয়েক লাখ দরিদ্রকে খাওয়াতে হবে ১৫ টাকা কেজি দরে। করতে হবে ‘ওপেন মার্কেট সেল’। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, বিভাগীয় ও জেলা শহর পর্যন্ত চালাতে হবে ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস)। তারপর খাওয়াতে পরাতে হবে পাঁচ-ছয় লাখ শরণার্থীকে। এরও শেষ নেই। আরও শরণার্থী আসতে পারে। মানবিক কারণে যেহেতু বাংলাদেশ তাদের দেখভালের সাময়িক দায়িত্ব নিয়েছে, তাই তাদের খাওয়াতে পরাতে হবে। এ বিশাল কর্মযজ্ঞে সরকাকে দৃশ্যমানভাবে বাজারে থাকতে হবে। এখনও এ কাজে সরকার দৃশ্যমান নয় বলেই দেখছি। আশা করা যায়, অবিলম্বে সরকার মাঠে নামবে। প্রধানমন্ত্রী এ আশ্বাস দিয়েছেন। চাল বিদেশ থেকে আসছে। সরকার যেমন ঋণপত্র (এলসি) খুলেছে, তেমনি খুলেছে বেসরকারি খাত। ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল ও গম আমদানি হবে। আশার কথা, আন্তর্জাতিক বাজারে চাল পাওয়া যাচ্ছে। গত কেয়ারটেকার সরকারের সময় টাকা দিয়েও চাল পাওয়া যাচ্ছিল না। এবার এমনটা নয়। জাতিসংঘের খাদ্য বিভাগ বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দামও কম। অতএব অচিরেই চাল বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করবে। তবু সাবধানের মার নেই। আমি বলব এমন ব্যবস্থা করতে, যাতে প্রতিবেশী দেশ থেকে চাল ‘আমদানি’ সহজতর হয়।
বেসরকারি ব্যবসায়ীরা এক টনের ‘ঋণপত্র’ খুলে যেমন দুই টন আনে, তেমনি তাদের ‘বললে’ অধিকতর চাল দ্রুত গতিতে আনতে পারে। অতীতে এটা হয়েছে। দরকার দুই দেশের পারস্পরিক সম্মতি। এটা হতেই পারে। কারণ বিষয়টি মানবিক। এটা করা গেলে ‘দেশপ্রেমিক’ ব্যবসায়ীরা সাবধান হয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে আরও দুটি পদক্ষেপের কথা বলি, যা জাতীয় ভিত্তিতে গ্রহণ করা দরকার। ব্যাংকগুলো চালের ঋণপত্র খুলেছেÑকিছু নগদে এবং কিছু ‘ডেফারড’ (বাকি) ভিত্তিতে। কোন ব্যাংক কত ‘এলসি’ খুলেছে, তার হিসাব আছে। ব্যাংকগুলোকে বলা হোক এ পণ্য যাতে দ্রুত শিপমেন্ট হয় তা ‘মনিটরিং’ করতে। কোনো গাফিলতি যাতে না হয়। আবার কুষ্টিয়া, দিনাজপুর এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চাতাল মালিক, চালকলের মালিক, আড়তদাররা ব্যাংক থেকে অনেক ‘লোন’ নিয়েছেন। লোনের টাকায় কেনা চাল যাতে তারা ধরে রাখতে না পারে, তার জন্য দরকার এসব লোন ‘রিটায়ার’ করে ফেলা অর্থাৎ পরিশোধের ব্যবস্থা করা। পুনশ্চ, যেসব চাল ব্যবসায়ী চাল ধরে রেখে বাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার প্রয়াস পাচ্ছেন, তাদের ওপর অধিকতর হারে ‘ট্যাক্স’ ধার্য করা উচিত। এবং এটা কড়াকড়িভাবে, যাতে তারা বোঝে অনৈতিকভাবে মুনাফা করলে সরকার সব ‘লাভ’ ট্যাক্স হিসেবে নিয়ে নেবে। এ পদক্ষেপগুলোর কথা বলে আরেকটি বিষয়ে কিছু বলা দরকার। আর এটা ভবিষ্যতের জন্য। কৃষির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। আবাদি জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। কৃষিকাজ অলাভজনক হয়ে পড়ছে, বিশেষ করে ধান-পাট ইত্যাদি চাষ। ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ জলের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। জলাধার নেই। নদীনালা ভরে ফেলা হচ্ছে। প্রতিবছর সার, অধিকতর সার দিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সফলতার কারণে এ সমস্যাগুলো আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়ে যাচ্ছে। জমির ‘টপসয়েল’ কৃত্রিম সার ব্যবহারের ফলে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা হিসাব করে দেখা দরকার। এটা কি বালিতে পরিণত হতে পারে? এমতাবস্থায় কি আমাদের প্রাকৃতিক সার ব্যবস্থার দিকে যাওয়া দরকার? তার জন্য প্রতি একরে কত গরু লাগবে, কত গোবর লাগবে? গাছের পাতা পচেও সার হয়। তার ব্যবস্থা কী? এসব এখন থেকেই ভাবা দরকার। অনেক দেশই এসব নিয়ে ভাবছে। নদী রক্ষা করা দরকার। এর জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। নদী ভাগাভাগি করে মাছ চাষ, পাহাড় কেটে স্থাপনা তৈরি ইত্যাদি প্রকৃতিবিষয়ক জিনিসের সঙ্গেও কৃষির সম্পর্ক রচনা করা দরকার। কৃষি ও প্রকৃতি যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তা আমাদের বোঝা দরকার। সর্বোপরি যে জিনিসটা আমাদের এ মুহূর্তে করা দরকার, তা হচ্ছে আমন ধান রোপণের ব্যবস্থা। আমনের চারা নষ্ট হয়েছে, বীজতলা নষ্ট হয়েছে। নতুন করে তা তৈরি করতে হবে। বৃহত্তর সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলা, উত্তরবঙ্গ, মধ্যবঙ্গ এবং নিম্ন বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষকরা দুই-দুইটা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের ফসল গেছে। গরু-ছাগল গেছে। ঘরবাড়ি গেছে। তাদের বিরাট একটা জনগোষ্ঠী এবার কোরবানির ঈদ স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারেনি।
তাদের পুনর্বাসন দরকার। তাদের ‘ক্যাশ’ দরকার। পুরোনো যে ব্যাংকঋণ আছে, তা পরিশোধে কড়াকড়ি প্রত্যাহার করা দরকার। সার্টিফিকেট মামলা যাতে না হয়, তার নির্দেশ দেওয়া দরকার। এনজিওগুলো তাদের কিস্তি তোলার জন্য যে অত্যাচার শুরু করে, তা থেকে তাদের উদ্ধার করা দরকার। সর্বোপরি তাদের বিশাল সংখ্যক লোককে খাদ্য দেওয়া দরকার। এ পুনর্বাসন, পুনর্নির্মাণের কাজের সঙ্গে জড়িত আমন ফসলের ভবিষ্যৎ। গ্রামীণ অর্থনীতি বিপর্যস্ত। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ইত্যাদি মেরামত না করলে গ্রামাঞ্চল উজ্জীবিত হবে না। আগামীর প্রস্তুতি হিসেবে তা করা দরকার। সর্বোপরি কাজ করা দরকার হিসাব করে। তিন মাস আগে সিলেটের বন্যাটি ছিল অকাল বন্যা। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। ধান গেছে প্রচুর। মাছ নষ্ট হয়েছে প্রচুর। তখন থেকেই চালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনে হয়, একে আমরা হিসাবে নিইনি। নেওয়া উচিত ছিল। গুদামে চালের স্টক ফুরিয়ে যাচ্ছে। এটা হিসাবের কথা। ওই গুদাম ভরার দায়িত্ব কার? আপৎকালীন মজুত রাখার দায়িত্ব কার? পরিকল্পিতভাবে চাল খরচ করলে, গুদাম চাল ভর্তি করার কাজ নিয়মিতভাবে করলে, আপৎকালীন মজুতের কথা মাথায় থাকলে আজকে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা হতো কি? সরকার যদি যখন-তখন চাল নিয়ে মাঠে নামতে পারত, তাহলে কি ব্যবসায়ীদের এত অনুরোধ; আবার অন্যদিকে ধমক দিতে হতো? মানছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে-কয়ে আসে না। এও কথা, এর জন্যই আপৎকালীন মজুতের কথা বলা হয়।
সবশেষে একটা কথা বলব। এ কাগজেই কিছুদিন আগে চালের কথা লিখতে গিয়ে ১৯৭৪ সালের একজন খাদ্যসচিবের কথা আকার-ইঙ্গিতে বলেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী এ কথাটাই আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বিষয়টি চালের। মরণ-বাঁচন সমস্যা। সমস্ত সাফল্য-কীর্তি নষ্ট হয়ে যাবে চালের ইস্যুতে পরাস্ত হলে। সরকারকে বলব, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীকে বলব ব্যক্তিগতভাবে ইস্যুটি হ্যান্ডল করতে। কারণ তার ‘স্টেইক’ই বেশি।
অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক
সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়