মীর কামরুজ্জামান মনি, যশোর: অসময়ে বৃষ্টি ও খারাপ আবহাওয়ায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন যশোরের শীতকালীন সবজি, সরষে, মসুর ও আলুচাষিরা। গত সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে তিন দিনের টানা বৃষ্টিপাতে মাটিতে মিশে গেছে এ অঞ্চলের শত শত কৃষকের স্বপ্ন। ফসলের এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবেন কি না, সে চিন্তায় পড়েছেন কৃষকরা। এরই মধ্যে চরম বিপর্যয়ে পড়েছেন প্রান্তিক চাষিরা। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের সহায়তার জন্য প্রত্যাশায় আছেন স্বপ্নভঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা।
চলতি মাসের শুরুর দিকে অসময়ের বৃষ্টিতে যশোরাঞ্চলের কৃষকের মাঠে মাঠে বিছানো পাকা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বৃষ্টিতে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সবজি, সরষে, মসুর ও গমের ক্ষেতের অধিকাংশই ক্ষতির মুখে পড়ে। বৃষ্টির পানিতে ভেসে যায় ক্ষেতের পাকা ধানও। সবজি ও রবি ফসলক্ষেতে পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে যায় শীতের নানা জাতের সবজি। ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে নি¤œচাপে তিন দিনে যশোর জেলায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয় ১৯০ মিলিমিটার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শীতকালীন সবজি, সরষে ও মসুর ক্ষেত। এর পাশাপাশি আলু ক্ষেত, পানের বরজ ও আমন ধান ক্ষতির মুখে পড়ে।
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর সূত্রে জানা গেছে, তিন দিনের বৃষ্টিতে জেলার আট উপজেলার প্রায় আট হাজার হেক্টর জমির কেটে রাখা ধান পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে যায় ২৫৩ হেক্টর জমির বীজতলা। এছাড়া গম ২৬ হেক্টর, আলু ২৫০ হেক্টর, সরষে ৯ হাজার ৯১০ হেক্টর, মসুর চার হাজার ১৬৩ হেক্টর ও চার হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে থাকা সবজি পানিতে ক্ষতির মুখে পড়ে। এসব সবজিচাষিদের এখন নতুন করে চাষ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কিন্তু অর্থের অভাবে তারা কীভাবে আবার চাষ শুরু করবেন, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন।
গত শনিবার যশোরের সবজি জোন এলাকা নোঙরপুরে গিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ সবজি ক্ষেতে এখনও পানি রয়েছে। কৃষক ক্ষেত থেকে আগেই পানি দিলেও ক্ষেতের সবজি বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। কথা হয় রাজাপুর মাঠে সবজিচাষি ইনায়েত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, মাত্র কয়েক দিন আগে দুই দফা বৃষ্টির কারণে আমরা সবজিচাষিরা ক্ষতির মুখে পড়ি। সেসময় যেসব জমিতে সবজি চারা রোপণ করেছিলাম, তা নষ্ট হয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয় দফা সবজি চাষ করে এখন তিন দিনের বৃষ্টিতে তা সব শেষ করে দিয়ে গেছে। তিনি বলেন, বেগুন, মুলা, পালংসহ যেসব সবজি রয়েছে, তা পানি জমে গোড়া পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের নতুন করে সবজি রোপণের চিন্তা করতে হচ্ছে, কিন্তু টাকা কোথায় পাব তা নিয়ে চিন্তায় আছি।
মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক চাষি সবজি পচে যাওয়ার ভয়ে অপরিপক্ব সবজি তুলে বাজারে তুলছেন। এতে কৃষক আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়লেও লাভবান হচ্ছেন খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে পুঁজি করে কৃষকদের কাছ থেকে পানির দামে সবজি কিনে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করছেন।
একই এলাকার চাষি কেরামত আলী বলেন, ঋণ করে উচ্চমূল্যে সার-কীটনাশক কিনে আমরা সবজি চাষ করেছিলাম। মনে করেছিলাম এবার ভালো লাভ করব, কিন্তু বৃষ্টি সে স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।
আবুল হোসেন নামে এক কৃষক বলেন, দেড় বিঘা জমিতে সরষে ও মসুর বুনেছিলাম। গাছের লক্ষণও ভালো ছিল, কিন্তু বৃষ্টির পানিতে ক্ষেত এখন থই-থই করছে। এসব ফসল আর ঘরে তোলা যাবে না বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, অসময়ে এমন বৃষ্টি হবে তা কখনও বুঝতে পারিনি। তিনি বলেন, সরকার যদি আমাদের প্রণোদনার আওতায় আনে, তাহলে আমরা আবার এসব জমিতে নতুন করে চাষ শুরু করতে পারব। নইলে আমাদের পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
এ বিষয়ে যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, বৃষ্টিতে কী পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে জরিপ চলছে। দু-এক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে জানা যাবে। তিনি বলেন, জাওয়াদের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত যশোরের সবজি ও রবি ফসলের ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এসব চাষিকে পুনর্বাসনের আওতায় আনার প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হবে।