অসম প্রতিযোগিতায় বন্ধ হয়ে গেছে চার প্রতিষ্ঠান

জয়নাল আবেদিন: মোবাইল ব্যাংকিং একটি অত্যাধুনিক সেবা। দিনের পর দিন বাড়ছে এর প্রচার ও প্রসার। কিন্তু সমানভাবে প্রসারিত হতে পারছে না মোবাইল সেবা প্রদানকারী সব প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে ১৫টি প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিয়ে এলেও এর বিপরীতে পুরো মোবাইল ব্যাংকিং খাতকে নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র দুই থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে সরকারের থেকে বাড়তি সুবিধা পেয়ে বাজার দখল করে নিয়েছে বিকাশ ও নগদ। ফলে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকিং কার্যক্রমের পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং এগিয়ে নিতে পারছে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিয়েও মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধ করে দিয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ২০২০ সালে এক্সিম ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংক তাদের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিযোগিতার ভয়ে লাইসেন্স নিয়েও সেবা দেয়াই শুরু করেনি প্রিমিয়ার ও ইস্টার্ন ব্যাংক। এছাড়া আরও কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ করবে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।

এ বিষয়ে আইএফআইসি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে জানান, নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞের কাছে অলরাউন্ডারের মূল্যায়ন কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। অনেক কাজের মধ্যে ব্যাংকের একটি উইং বা অংশের নাম মোবাইল ব্যাংকিং। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠান আছে মোবাইল ব্যাংকিংটাই যাদের মূল কাজ। অন্য কোনো কাজে তাদের মনোযোগ নেই। সে কারণে তারা ব্যাংকের তুলনায় অনেক ভালো করছে। দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে তাদের সেবা ও গ্রাহকের সংখ্যা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ১৫টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। বিকাশ, রকেট, মাইক্যাশ, এমক্যাশ, ট্রাস্ট আজিয়াটা পে, ফার্স্ট পে শিউরক্যাশ, ইউপে, ওকে ব্যাংকিং, রূপালী ব্যাংক শিউরক্যাশ, টেলিক্যাশ, ইসলামিক ওয়ালেট, স্পট ক্যাশ এবং মেঘনা ব্যাংক ট্যাপ এন পে নামে চলছে মোবাইল ব্যাংকিং। এগুলোর মধ্যে সরকারের থেকে নানা সুবিধা নিয়ে দ্রুত বাজার দখল করেছে বিকাশ। আর ডাক বিভাগের সাবসিডিয়ারি হিসেবে নগদও সরকারের নানা সুবিধা নিয়ে ফুলে-ফেঁপে ওঠে।

বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার ১৪১ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। গত জুলাই মাসের তথ্য বলছে, এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নিবন্ধিত গ্রাহক ৯ কোটি ৯৮ লাখ। লেনদেনের দিক থেকে ৬৫ শতাংশ বিকাশ, ১৯ শতাংশ রকেট ও বাকি অংশ অন্যান্য ব্যাংকের দখলে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবন্ধিত না হওয়ায় নগদের কোনো তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই। যদিও বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে মার্কেট শেয়ারের দিক থেকে নগদ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েও সামনে অগ্রসর হয়নি ইস্টার্ন ও প্রিমিয়ার ব্যাংক। তারা বলছে, ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনা করা বেশ কঠিন। কারণ এই সেবা দিতে হলে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞ জনবলের প্রয়োজন। ব্যাংকে এরকম কর্মকর্তার সংকট রয়েছে। তাছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান মোবাইল ব্যাংকিংয়ে খুব ভালো করছে, তাদের চিন্তা-ভাবনা এককেন্দ্রিক। তারা ব্যাংকিং ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত নয়। সে কারণে তারা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আর প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধ করে দিচ্ছে অন্যান্য ব্যাংক।

এ বিষয়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকের রিটেইল ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান শামিম মুরশেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘প্রথমে আমরা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর সিদ্ধান্ত নিলেও পরে তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। ফিজিবিলিটি অ্যানালাইসিস বা সম্ভাব্যতা বিশ্লেষণ করে আর সামনে এগুইনি। কারণ এখানে ভালো করতে হলে আলাদা ম্যানেজমেন্ট ও প্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ জনশক্তি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সে জায়গাতে আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না। শুধু আমরা নই, সাবসিডিয়ারি কোম্পানি ছাড়া যারা এ সেবা চালু করেছে তাদের বেশিরভাগেরই অবস্থা এখন শোচনীয়।’

তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি বাজার দখলকারী বিকাশের মাধ্যমে এখন যেসব সেবা পাওয়া যায়, তার মধ্যে রয়েছেÑসহজে টাকা পাঠানোর সুবিধা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ইন্টারনেট বিল অর্থাৎ সেবামূল্য পরিশোধ, কেনাকাটার বিল পরিশোধ, বেতন-বোনাস প্রদান, সরকারের সামাজিক সুরক্ষার বিভিন্ন ভাতা, বিদেশ থেকে টাকা পাঠানো অর্থাৎ রেমিট্যান্স প্রেরণ, ইন্স্যুরেন্সের টাকা প্রদান প্রভৃতি। এর বিপরীতে ব্যাংকভিত্তিক মোবাইল ব্যাংকিং সেবার পরিধি কিছুটা কম। সেবার পরিধি বেশি হওয়ার কারণে বিকাশ বা রকেটের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ বেশি।

এ বিষয়ে বিকাশের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা শামছুদ্দিন হায়দার ডালিম শেয়ার বিজকে জানান, ‘আমরা ব্র্যাক ব্যাংকের একাটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান। এককেন্দ্রিক সেবা দেয়ার কারণে আমাদের অগ্রগতি অন্যদের চেয়ে বেশি। আমাদের জনবল ও প্রযুক্তি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তাছাড়া আমরা সহজে গ্রাহকের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে চাই। তাই যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত বাস্তবায়িত হয়। এ কারণে বিভিন্ন ব্যাংকও এখন আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে চাচ্ছে। এসব ব্যাংকের বিভিন্ন সেবা এখন বিকাশের মাধ্যমে দেয়া হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিং লাইসেন্সের জন্য বর্তমানের মতো শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আবেদন করতে পারবে। নতুন করে কোনো ব্যাংকের এমএফএস সেবা চালু করতে হলে নতুন নীতিমালার আলোকে আলাদা সাবসিডিয়ারির জন্য আবেদন করতে হবে। আর লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হবে দুই ধাপে। প্রথম দফায় নো অবজেকশন সার্টিফিকেট বা এনওসি নিতে হবে। এরপর চূড়ান্ত লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হবে। সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ লাইসেন্সের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। লাইসেন্স পাওয়ার পর ১২ মাসের মধ্যে কার্যক্রম শুরু না করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলে ওই প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করতে পারবে। এতদিন একটি ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিত শুধু অনাপত্তি দেয়া হতো।

নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, মোবাইল নম্বর হবে গ্রাহকের মোবাইল অ্যাকাউন্ট। নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে অ্যাকাউন্ট খোলার পর গ্রাহকরা এজেন্ট পয়েন্ট ছাড়াও এটিএম বুথ, ব্যাংকের শাখা ও লিংক ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ক্যাশ-ইন ও ক্যাশআউট করতে পারবে। অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বেতন-ভাতা পরিশোধ, সরকার থেকে ব্যক্তির পরিশোধ, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, ব্যবসায়িক পরিশোধ এবং ই-কমার্সের পরিশোধ করা যাবে। বৈধ উপায়ে ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্থ সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে। তবে কোনো অবস্থায় দেশের বাইরে থেকে রেমিট্যান্সের অর্থ দেশে আনা যাবে না।

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০