ফারুক আলম, লালমনিরহাট: লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের ডে লেবার (দিনমজুর) হিসেবে বিদ্যুতের খুঁটি লাগানোর কাজ করতে গিয়ে অনেকেই এখনও শরীরে মারাত্মক ক্ষত নিয়ে দিনপাত করছেন। কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে এসব শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হলেও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কোনো কর্মকর্তাই এখন এদের খোঁজ রাখেন না। ফলে এসব ক্ষত নিয়েই বেকার জীবন কাটাচ্ছেন তারা। এদের মধ্যে একজন আদিতমারির রাশেদুল ইসলাম। ৩০০টি মজুরিতে ডে লেবারের কাজ করতে গিয়ে এখন পঙ্গু।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু রাশেদুল নয়, বিদ্যুতের খুঁটি লাগাতে গিয়ে এমন অনেক শ্রমিকের কারও হাত উড়ে গেছে। কারও পুরো শরীরে প্লাস্টিক সার্জারি। কেউ হাতের সার্জারির জন্য কাজ করতে পারেন না। পেটের মধ্যে তিন ইঞ্চি ডিপে প্লাস্টিক সার্জারি করা। মৃত্যুর পথ থেকে ফিরে আসা এসব মানুষ। হাসপাতালের বিছানায় কেটেছে মাসের পর মাস। এখনও শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা, মনে ভয় ৪০ ফুট ওপর থেকে পড়ে যাওয়ার। আধমরা এসব মানুষ এখন বেকার। অনেকেই ৪০ ফিট সেই খুঁটি থেকে পড়ে চলে গেছেন পরপারে। মৃত মানুষকে পরিবার আর আধমরা মানুষগুলোর খোঁজ রাখে না কেউ। তাদের কাজ ফুরিয়েছে। তারা এখন অপ্রয়োজনীয়। এদের খোঁজ রাখে না পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষও।
অবাক করার তথ্য হচ্ছে, এদের পেছনে খরচ করার জন্য অফিশিয়ালি কোনো তহবিলই নেই। একটি টাকাও প্রতিষ্ঠানটি ব্যয় করে না ডে লেবার হিসেবে নিয়োগ করা এসব খেটে খাওয়া মানুষের জন্য। অথচ এরা সবাই পল্লী বিদ্যুতের কাজ করতে গিয়ে জীবন হারিয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, দুঃসহ যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ এখনও রাত দিন, ঝড়ঝঞ্ঝায় এদেরই ডেকে নিয়ে খুঁটিতে চড়িয়ে দেয়। লাইন মেরামত করে। সারাদিন কিংবা ২৪ ঘণ্টার অকান্ত শ্রমের বিনিময়ে পায় ৩০০ টাকা! এভাবেই চলছে পল্লী বিদ্যুতের ডে লেবারদের জীবন। এদের না আছে বেতন, পরিচয়পত্র, না আছে ঝুঁকির বিপরীতে ন্যূনতম নিশ্চয়তা।
শ্রমজীবী এসব মানুষের প্রতিদিনের কাজের বিপরীতে নিয়োগ করা হয়। কাজ শেষে বিদায়। নিয়োগ করে অফিসের লাইনম্যান, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। অফিস, চিকিৎসার কাগজ, প্রত্যক্ষদর্শী, নথি বলছে, আদিতমারী পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিসের লাইনম্যান ফিরোজ। তিনি ২০২০ সালের জুন মাসে বাড়ি থেকে ডেকে নেন রাশেদুল ইসলামকে। আদিতমারী এলাকার একটি খুঁটিতে তুলে দেন। সেই খুঁটির কাজ শেষে নেমে পড়েন রাশেদুল। তিনটা খুঁটির পরে আর একটি খুঁটিতে ওঠার নির্দেশ দেন। এর মধ্যে সাবস্টেশন থেকে লাইন চালু করেন লাইনম্যান ফিরোজ। রাশেদুলকে খুঁটিতে চড়ার পরে ফিরোজ লাইনের শাটডাউন (লাইনবন্ধ) চেক করেনি। ফলে রাশেদুল খুঁটিতে চড়ে লাইনে হাত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে মাটিতে পড়ে যান। আগুন জ্বলে ওঠে। শরীর পুড়ে যায়। পেটের মাংস, ঘাড়ের মাংস, বগলের মাংস উড়ে যায় ৫০ ফিট দূরে। দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানো হয়। সেখানে অচেতন রাশেদুলের চিকিৎসা চলে প্রায় এক বছর। চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে ২ বছর থেকে যন্ত্রণাকাতর বেকার জীবন পার করছেন রাশেদুল।
রাশেদুল বলেন, আমি শুনেছি আমার মৃত্যুর খবর শুনে আমার বউয়ের নামে অ্যাকাউন্ট করে দেয় ফিরোজ। আদিতমারী জনতা ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর ০১০০২১৪১৬১৩৭৫। এ পর্যন্ত একটি টাকাও জমা হয়নি। টাকা জমার কথা বলে, আমার কাছে সই নিয়েছে কাগজে। আমি কোনো কাজ করে জীবন চালাব এর উপায় নেই। তিনি এখন পাত্তা দেন না।
তৎকালীন এজিএম এ কে এম সফিউল আলম (ডিজিএম এলেঙ্গা) বলেন, ফিরোজ ব্যক্তিগতভাবে তাকে হেল্প করার কথা। আমি নিজে রাশেদুল ও গনেশকে হেল্প করেছি। অফিসে একটি দরখাস্ত করা ছিল। এখন যারা আছেন, তাদের কাছে একটু খোঁজ নেবেন। ফিরোজ, ইনচার্জ রফিকুল দায়িত্বে ছিল। এরা সমস্যার সমাধান করার কথা।
একই স্টেশনে স্বপদে বহাল থাকা লাইনম্যান ফিরোজ রাশেদুলকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়ার কথা অস্বীকার করে বলেন, আমার কাছে সব হিসাব আছে। তবে, আজকাল পরশু করে ফিরোজ ২৬ দিন পরেও কোনো তার হিসাবের কাগজ দেখাননি। পরে তিনি বলেন, ডিজিএম স্যার কোনো ডকুমেন্ট বা কথা বলতে নিষেধ করেছেন। তবে ডিজিএম ফিরোজের এ বক্তব্য অস্বীকার করেছেন।
পল্লী বিদ্যুতের ডে লেবার আর ইলেকট্রিশিয়ান বলছেন, রাশেদুলকে সেদিন ফিরোজ নিয়ে গেছে। তারপর তো শুনি রাশেদুল মারাই গেছে। তখনকার এজিএম আর আমরা সব ইলেকট্রিশিয়ান মিলে রাশেদুলের চিকিৎসা করেছি। এখানে ফিরোজ কোনো টাকা দেয়নি।
এ বিষয়ে ডিজিএম (দায়িত্বপ্রাপ্ত জিএম, কুড়িগ্রাম লালমনিরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি) বলেন, খুঁটিতে ওঠার জন্য আমরা দেনিক ভিত্তিতে কোনো কর্মী নিয়োগ দিইনি। আমার সঙ্গে ফিরোজের কথা হয়নি। আমার দায়িত্বে কোনো অনিয়ম হতে দেবো না।