Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 3:55 am

অস্থায়ী সরকারের রাজধানীতে একদিন…

বছরজুড়ে ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশন নিয়ে সময় পার হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে মনে হয় চেনা গণ্ডি পেরিয়ে দূরে কোথাও যাই। যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে তাই পাড়ি জমাই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের রাজধানী মুজিবনগরে
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা দুটি বাস নিয়ে শিক্ষা সফরে রওনা হন মেহেরপুরের মুজিবনগরে। ব্যাচের ১০০ শিক্ষার্থীর সঙ্গে ছিলেন চার শিক্ষকও।
দিনটি ছিল শুক্রবার। ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার সময় ভোর ৬টা। যেহেতু অনেক দুরের পথ, তাই ক্লাস প্রতিনিধির কড়া নির্দেশ কোনোভাবেই দেরি করা যাবে না। বসন্ত শুরু হলেও কুয়াশাচ্ছন্ন চারদিক। নির্দেশমতো ঠিক ৬টার মধ্যেই প্রায় সবাই রবীন্দ্র ভবনের সামনে উপস্থিত হই। প্রয়োজনীয় জিনিস বাসে তুলে অপেক্ষা করতে থাকি শিক্ষকদের জন্য। প্রথমে আসেন অধ্যাপক রাইহানা আনসারী। কিছুক্ষণ পরে আসেন সহযোগী অধ্যাপক ড. আবু সাদেক মোহাম্মাদ কামরুজ্জামান, সহকারী অধ্যাপক আশিকুল ইসলাম ও সহকারী অধ্যাপক হেদায়েত উল্লাহ্ (পাপুল)। সঙ্গে ছিলেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।
আমরা সকাল ৭টায় রওনা হই। পথে নামতেই ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা গায়ে এসে লাগল। আহা কী অসাধারণ সুন্দর চারদিক! মৃদু বাতাসের আবেশে আচ্ছন্ন হতে থাকলাম। বাস চলতে লাগল আর ভেতরে সাউন্ড সিস্টেমের শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল যেন বাসের ভেতরে ভূমিকম্প হচ্ছে। যেমন খুশি তেমন নৃত্য চলছে বাসজুড়ে। কত স্টাইল, কত ভঙ্গিতে চলছে আমাদের নাচ! আমি নিশ্চিত এর ভালো কোনো ভিডিও ক্লিপ থাকলে ইউটিউবে ভাইরাল করা যেত।
প্রায় পুরোটা রাস্তা মাঝেমধ্যে বিরতি নিয়ে চলল আমাদের ড্যান্স। আমাদের সঙ্গে নাচেন পাপুল স্যারও। স্যারের ডান্স ও বন্ধুসুলভ আচরণে আমরা বিমোহিত। বাসের মধ্যেই সকালের নাস্তা সেরে নিই আমরা। কিছুদূর এগোতেই চলে আসি বাংলাদেশের দীর্ঘ রেলসেতু পরিচিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে। এখানে কিছুটা যাত্রাবিরতি দিয়ে আবারও চলতে লাগলাম গন্তব্যের দিকে।
অবশেষে যখন পৌঁছালাম তখন মোটামুটি দুপুর হতে চলেছে। প্রথমেই গেলাম আম্রকাননে। আম্রকানন কিংবা আমবাগান বা বৈদ্যনাথ তলা, যে নামেই ডাকা হোক না কেন সূর্যের আলোয় আলোকিত আমবাগান দেখে বিমোহিত হয়ে পড়ি আমরা। এই বাগানেই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথ নেন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। শপথ গ্রহণ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একটি বিবৃতি পাঠ করেন এবং বৈদ্যনাথ তলার নাম রাখেন মুজিবনগর।
আমবাগানের মুগ্ধতা কাটিয়ে আরও মিনিটখানেক হেঁটে চলে এলাম সেখানে অবস্থিত বাংলাদেশের মানচিত্রের কাছে। যুদ্ধকালীন অবস্থার রূপক এ মানচিত্র। কোন এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে, শরণার্থীরা কীভাবে দেশ ছেড়েছিলেন সেসব এখানে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে মহান মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে ভাগ করে দেখানো হয়েছে মানচিত্রে। পুরো কমপ্লেক্স ঘুরে যে যার মতো ছবি তোলা আর নিজের এলাকার অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছিলেন।
মানচিত্রের পাশেই মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ স্থাপনার মূল বৈশিষ্ট্য ১৬০ ফুট ব্যাসের গোলাকার স্তম্ভের ওপর মূল বেদিকে কেন্দ্র করে ২০ ইঞ্চির ২৩টি দেওয়াল। দেওয়ালগুলো উদীয়মান সূর্যের প্রতীক। ৩০ লাখ শহীদকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য স্মৃতিসৌধের মেঝেতে ৩০ লাখ পাথর বসানো হয়েছে। সৌধের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে লাল মঞ্চ, ২৩টি স্তম্ভ, এক লাখ বুদ্ধিজীবীর খুলি, ৩০ লাখ শহীদ, ১১টি সিঁড়ি, বঙ্গোপসাগর, ২১ ফেব্রুয়ারি, রক্তের সাগর ও ঐক্যবদ্ধ সাড়ে সাত কোটি জনতাকে।
মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্স বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্মের জন্য অন্যতম বড় উপহার আর শিক্ষণীয় হতে পারে প্রথম সরকারের এ ভূমি।
সবকিছু দেখা শেষে পিকনিক স্পটে ফেরার পালা। যে অংশতে রান্নাবান্না চলছিল সেখানে এসে দেখি খাবার হতে কিছুটা সময় লাগবে। সেই ফাঁকে আবারও সবাই ফ্রেমে বন্দি হতে ব্যস্ত। শিক্ষক আর বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে সেলফি, গ্রুপ ফটো আর ঘোরাঘুরি করে সময়টুকু পার করি। পরে খাওয়াদাওয়ার পালা। এরপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিই আমরা। এবার বিদায়ের পালা। মাঝপথে আবার শুরু হলো আমাদের তুমুল নৃত্য। ফেরার পথেও মাঝেমধ্যে বিরতি নিয়ে চলল আমাদের ড্যান্স। বাকি রাস্তা বেশ আনন্দ-উল্লাসে কাটিয়েই ফিরে আসি ক্যাম্পাসে।

এম আর মামুন