বিআরটিএ’র অসহযোগিতা

অ্যাম্বুলেন্স ঘোষণায় আমদানি হচ্ছে মাইক্রোবাস!

রহমত রহমান: জরুরি চিকিৎসাসেবার কাজে ব্যবহৃত অ্যাম্বুলেন্স আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা দিয়ে শুল্ককর কমিয়েছে সরকার। কিন্তু এ সুবিধার অপব্যবহার হচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি হয় কিন্তু রেজিস্ট্রেশন হয় মাইক্রোবাস হিসেবে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও বিআরটিএ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ অপকর্ম হয়ে আসছে। গত তিন বছরে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ১৩১৩টি মোটরযান আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে কতটি মাইক্রোবাস হিসেবে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে তা জানে না কাস্টমস। বিআরটিএ’র কাছে তথ্য চাইলেও সহযোগিতা না করার অভি

অপব্যবহার রোধে মোটরযান খালাসের সময় মাইক্রোবাস হিসেবে ব্যাংক গ্যারান্টি নেওয়া, রেজিস্ট্রেশন তদারকিতে বিআরটিএ’র সাভারে কাস্টমসের প্রবেশের অনুমতির সুপারিশ করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, একটি ১৯৯৮ সিসির হাইয়েস মাইক্রোবাসের মোট শুল্ক করহার ১৫০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। আর একই সিসির একটি হাইয়েস অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি করলে মোট শুল্ককর ৩১ শতাংশ। ফলে অ্যাম্বুলেন্সে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে ১১৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। কাস্টমসের হিসাবে গত তিন বছরে ১২০০ থেকে ২৭০০ সিসির মাইক্রোবাস অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি হয়েছে ১৩১৩টি মোটরযান। মাইক্রোবাস সিসিভেদে শুল্ককরসহ মূল্য দাঁড়ায় ২২ থেকে ২৫ লাখ টাকা।

অপরদিকে, অ্যাম্বুলেন্স হলে শুল্ককরসহ মূল্য দাঁড়ায় ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ, মাইক্রোবাস অপেক্ষা অ্যাম্বুলেন্সের দাম প্রায় অর্ধেক কম। অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে শুল্কায়ন করা হলেও মাইক্রোবাস হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হয়। এতে সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। সম্প্রতি গাজীপুরে অ্যাম্বুলেন্স ঘোষণায় আমদানি করা মাইক্রোবাসের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, দেশে ঢুকেই অ্যাম্বুলেন্স হয়ে যাচ্ছে মাইক্রোবাস। এসআই অটোমোবাইলস, টারবো অটো, এফবিটি অটোমোবাইলস, জেআর অটোমোবাইলস ও লামিয়া এন্টারপ্রাইজসহ কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এসব মাইক্রোবাসকে অ্যাম্বুলেন্স দেখিয়ে আমদানি করেছে।

২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর দৈনিক শেয়ার বিজ পত্রিকার লিড নিউজ

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম এনবিআর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন। এতে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১১ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৮৯৬ চালানে মোট এক হাজার ৩১৩টি অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে শুল্কায়ন শেষে খালাস নিয়েছে। শতাধিক মোটরযান ব্যবসায়ী অ্যাম্বুলেন্স আমদানি করেছেন। এর মধ্যে নাভানা ট্রেডিং, আকিজ মোটরস, মিরাজ কারস, গ্রীনল্যান্ড অটো, এলএনবি অটোমোবাইলস, হাবিব অ্যান্ড ব্রাদার, হাতিম করপোরেশন, এফবিটি অটোমোবাইলস, কেআরএস করপোরেশন, জারা ইন্টারন্যাশনাল, আরকে ইন্টারন্যাশনাল, আনোয়ার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এমএন অটোমোবাইলস, আবিদ অটোমোবাইলস, ম্যাক্স পাওয়ার বাংলাদেশ, ডায়নামিক ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, এইচএ ট্রেডিং, এসএম অটোমোবাইলস, এনএফ এন্টারপ্রাইজ, জেঅ্যান্ডএফ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, সালসাবিল অটো, লাইমা এন্টারপ্রাইজ, আল মারজুক ট্রেডিং, বিডি ট্রেড অ্যান্ড কোম্পানি, মাফারা ইন্টারন্যাশনাল, স্টার লাইন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, হাতিম করপোরেশন সবচেয়ে বেশি অ্যাম্বুলেন্স আমদানি করেছে।

এদিকে বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার ৯৩০টি অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। আর সারা দেশে নিবন্ধিত অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ছয় হাজার ১৮৪টি। এর মধ্যে ২০১০ পর্যন্ত নিবন্ধন নিয়েছে দুই হাজার ৭৯৩টি। বাকিগুলোর ২০১১ থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, দেশে অ্যাম্বুলেন্স ঘোষণায় বিপুল মাইক্রোবাস আমদানি হচ্ছে। মাইক্রোবাস অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে শুল্কায়ন হয়ে বের হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ২০১৬ সালে এনবিআরের নজরে আসে। পরে অ্যাম্বুলেন্স ঘোষণায় মাইক্রোবাস শুল্কায়ন যাতে করতে না পারে, সেজন্য সব কাস্টম হাউসকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। যাতে বলা হয়, উত্তরা মোটরস বেনাপোল কাস্টম হাউস দিয়ে ইকো অ্যাম্বুলেন্স আমদানি করে। এর অপব্যবহার রোধে ব্যাংক গ্যারান্টি রেখে সাময়িক শুল্কায়ন করে খালাস দেয়। এ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে এনবিআর ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়া শুল্কায়ন করে খালাস দিতে সব কাস্টম হাউসকে নির্দেশনা দেয়। একই সঙ্গে খালাস করা অ্যাম্বুলেন্সের ইঞ্জিন, চেসিস উল্লেখ করে বিআরটিএকে চিঠি দিতে বলা হয়, যাতে অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া মাইক্রোবাস হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নিতে না পারে। কিন্তু অসাধু আমদানিকারক আর বিআরটিএ কর্মকর্তার যোগসাজশে অ্যাম্বুলেন্স মাইক্রোবাস হিসেবেই রেজিস্ট্রেশন নিচ্ছে।

কমিশনার ফখরুল ইসলাম চিঠিতে বলেন, যে পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স মাইক্রোবাস হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয়েছে, তা সঠিক কি না জানাতে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে কয়েকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের জবাব দেয়নি কর্তৃপক্ষ। পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে খালাস নেওয়া আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করা হয়। তারা জানিয়েছে, যেসব ব্যবসায়ী থেকে মাইক্রোবাসগুলো কেনা হয়েছে, সেসব ব্যবসায়ী ও বিআরটিএ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে  রেজিস্ট্রেশন করে। পাঁচটি ছাড়াও অন্য মোটরযানের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অপব্যবহার রোধে তিনি এনবিআর চেয়ারম্যানকে তিনটি সুপারিশ করেন। এতে বলা হয়: অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে শুল্ককর নগদে আদায় করা, মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্সের পার্থক্যজনিত শুল্ককর ব্যাংক গ্যারান্টি হিসেবে রেখে মোটরযান খালাস করা, ছয় মাসের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে রেজিস্ট্রেশনের দলিলাদি দিলে ব্যাংক গ্যারান্টি ফেরত দেওয়া, এরই মধ্যে যেসব কর্মকর্তা অ্যাম্বুলেন্সকে মাইক্রোবাস হিসেবে রেজিস্ট্রেশন দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করতে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করা, কয়েক বছরে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে খালাস নেওয়া মোটরযান অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছে কি না তা যাচাই করতে বিআরটিএ’র সার্ভারে কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রবেশের অনুমতি দিতে বিআরটিএ চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করা, প্রয়োজনে তথ্য যাচাইয়ে বিআরটিএ-এনবিআর চুক্তি সই করা প্রভৃতি রয়েছে।

এ বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান ড. মো. কামরুল আহসান শেয়ার বিজকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নেব। তিনি পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। মো. লোকমান হোসেন ভূঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, গাজীপুরের এক ব্যবসায়ী অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি করা দুটি মোটরযান মাইক্রোবাস হিসেবে রেজিস্ট্রেশন নিয়েছেন। নজরে আসার পর আমরা রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছি। এ নিয়ে ওই ব্যবসায়ী আমাদের বিরুদ্ধে রিট করেছেন। সে মামলায় আমরা লড়ছি। অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে আমদানি করে মাইক্রো হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ৭০টি পয়েন্ট থেকে রেজিস্ট্রেশন হয়। আমি তো রেজিস্ট্রেশন দিই না। তবে প্রতি সপ্তাহে কাস্টমস থেকে চিঠি আসে অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে রেজিস্ট্রেশন দিতে। সে অনুযায়ী সব রেজিস্ট্রেশন পয়েন্টকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়। যদি কেউ এ ধরনের কাজ করে থাকে, তা বেআইনি। তারপরও আমরা খতিয়ে দেখব।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০