Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 5:28 am

অ্যাসবেস্টস ব্যবহারে রাজস্ব আসছে ২৬০ কোটি টাকা

ড. এসএম মোর্শেদ। বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ ও এনভায়রনমেন্টের (ওশি) ভাইস চেয়ারপারসন। দীর্ঘ প্রায় ২১ বছর ধরে দেশের শ্রমিকদের স্বাস্থ্য-সুরক্ষা, সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন। সম্প্রতি এ খাতের বিভিন্ন বিষয় ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা হয় দৈনিক শেয়ার বিজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হামিদুর রহমান

শেয়ার বিজ: বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ ও এনভায়রনমেন্ট (ওশি) সম্পর্কে জানতে চাই। ওশির পথচলা কত বছরের, অর্জন কী কী? আপনি কবে থেকে ওশির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একই সঙ্গে আপনি এ খাতে কত বছর ধরে কাজ করছেন বা গবেষণা করছেন?

ড. এসএম মোর্শেদ: ২০০৩ সালে বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ ও এনভায়রনমেন্টের (ওশি) যাত্রা শুরু। আমরা মূলত পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছি। এর বাইরে আমরা শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা ও সামাজিক কল্যাণ নিয়ে কাজ করি। অর্থাৎ আমাদের মূল ফোকাস হচ্ছে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা। আমরা বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করিÑফরমাল ও ইনফরমাল সেক্টর। যেমন আমরা গার্মেন্ট নিয়ে কাজ করি। একইভাবে আমরা ইনফরমাল সেক্টর, অর্থাৎ নির্মাণ শ্রমিকদের ট্রেনিং দিই। আমরা মনে করি, দেশের শ্রমশক্তির ৮৫ শতাংশই ইনফরমাল সেক্টরে কাজ করে। যেহেতু আমাদের দেশের শ্রম আইন তাদের কাভার করে না, সে কারণে শ্রমিকদের অনেকে নানা বিষয় থেকে বঞ্চিত। শ্রমিকদের কোনো ওয়েজেস স্ট্রাকচার নেই। তারা ফিস-ভিত্তিক কাজ করেন, চুক্তিতে কাজ করেন। অর্থাৎ যার সঙ্গে যেভাবে চুক্তি হয়, সেভাবেই কাজ করেন। বাংলাদেশের শ্রম আইন ইনফরমাল সেক্টরকে কাভার না করায় শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। সেজন্য আমাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও ক্যাম্পেইন কার্যক্রমে শ্রমিকরা বেনিফেশিয়ার হচ্ছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েও কাজ করি।

শ্রমিকদের কিছু রোগব্যাধি হয়। এটিকে বলা হয় পেশাগত ব্যাধি। শ্রম আইন অনুযায়ী এটি ক্ষতিপূরণযোগ্য। অর্থাৎ কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে মালিকপক্ষ তাদের ক্ষতিপূরণ দেবে। এমন অনেক দিক আছেÑকয়জন নারী শ্রমিক থাকলে পৃথক টয়লেট করতে হবে, কয়জন শ্রমিক থাকলে ডে-কেয়ার সেন্টার করতে হবে। আবার চা-শ্রমিকদের জন্য আলাদা আইন আছে। চা বাগানে শ্রমিকদের অনেকেই বাচ্চা নিয়ে আসে, সেখানে বাচ্চা রাখার একটা জায়গা দিতে হয় এবং পুষ্টিকর খাবারও দিতে হবে। অর্থাৎ শ্রম বিধিমালায় যে বিষয়গুলো বলা আছে, তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না সেগুলোই ফলো করি।

শেয়ার বিজ: ওশির দেশি ও বিদেশি পার্টনার কে?

এসএম মোর্শেদ: বিদেশি কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা ওশিকে ফান্ড দেয়। এ মুহূর্তে আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফান্ড দিচ্ছে, জার্মানির জিআইজেড এক্সিলেন্ট মনিটরিংয়ের জন্য আমাদের ফান্ড করছে, কোরিয়া বেজড এএমআরসি নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে তারাও রিসার্চ বেজড কাজের জন্য আমাদের ফান্ড করছে, ডব্লিউএইচএন নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে, তারা আমাদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য কিছু ফান্ডিং করে। এছাড়া ছোটখাটো আরও অনেকের সঙ্গে আমাদের পার্টনারশিপ আছে।

শেয়ার বিজ: আপনারা বলছেন, অ্যাসবেস্টস ব্যবহারে মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। অথচ ১৯৬৯ সাল থেকে দেশে সিমেন্ট শিট উৎপাদিত হচ্ছে। এত লম্বা সময়ে দেশে একটিও অ্যাসবেস্টস সম্পর্কিত ক্যানসারের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি এবং কোনো লোকের মৃত্যুও ঘটেনি। তাহলে বিষয়টি সাংঘর্ষিক কি না?

এসএম মোর্শেদ: আমাদের মালিকরা চা বাগানে অ্যাসবেস্টস শিটের ঘর করে দিয়েছে, যেহেতু অ্যাসবেস্টস শিট দীর্ঘস্থায়ী হয়, আগুনে পোড়ে না। তবে এখানে ক্ষতিকর উপাদান আছে। এটি সঙ্গে সঙ্গে শরীরে ধরা পড়ে না। একটা দীর্ঘ সময় পরে অর্থাৎ ১০ থেকে ১৫ বছর পর তাদের শরীরে ইফেক্ট পড়ছে। যদি ডেঙ্গুর মতো হতো তাহলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যেতে হতো। এজন্য আমরা এটিকে বলি নীরব ঘাতক। এটি শরীরে প্রবেশ করলে সঙ্গে সঙ্গে ইফেক্ট পড়ে না। একটা লম্বা সময় পর মানুষের শরীরে এই ব্যাধি ধরা পড়ছে। আর এত লম্বা সময় পর যখন শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে, তখন তো বোঝার উপায় নেই কখন থেকে বা কী কারণে এটি হয়েছে। অ্যাসবেস্টসের কারণে মৃত্যু হলেও সেটি আপনি জানতে পারছেন না। কারণ আপনি তো রোগ নির্ণয় (ডায়াগনসিস) করেননি। কীভাবে মৃত্যু হচ্ছে তা আমাদের দেশে পরীক্ষা হচ্ছে না, বা ডায়াগনসিস হচ্ছে না, যে কারণে স্পেসিফিক এ খাতে ক্যানসারে মৃত্যুর কারণ পাওয়া যাচ্ছে না।

শেয়ার বিজ: ধরেও নিই, আমাদের দেশে শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ ডায়াগনসিস হচ্ছে না। তবে ইন্ডিয়াতেও তো এমন রিপোর্ট পাচ্ছি না যে, অ্যাসবেস্টসের কারণে কারও ক্যানসার হচ্ছে বা মৃত্যু হচ্ছে? তাহলে এর কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

এসএম মোর্শেদ: ভারতেও একই অবস্থা। বলতে পারেন, আমাদের তুলনায় ভারতের আরও বাজে অবস্থা। সেখানে ফুসফুস ও শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা প্রচুর, মানুষ একটি পর্যায়ে এসে ইন্যাকটিভ হয়ে যাচ্ছে। ভারতে এ খাতে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। ওয়েবসাইটে ঢুকলে দেখবেন ফাস্ট অ্যাসবেস্টস প্রোডাকশন কান্ট্রিস, কোন দেশ কী পরিমাণ এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট করে। আমাদেরও গবেষণা আছে, বাংলাদেশে এ খাতে প্রায় ২৬০ কোটি টাকার মতো রেভিনিউ জেনারেট হচ্ছে।

শেয়ার বিজ: অ্যাসবেস্টস ব্যবহারে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ঝুঁকি কেমন? প্রতি বছর কী পরিমাণ মানুষ মৃত্যুঝুঁকিতে পড়ছে? মৃতের সংখ্যা কেমন? কোনো গবেষণা আছে কি?

এসএম মোর্শেদ: অ্যাসবেস্টস মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ বলে এটি বিশ্বের ১৬২টি দেশে নিষিদ্ধ। আমাদের দেশের সরকার প্রচুর রেভিনিউ আর্ন করে বলে এটি ব্যান করেনি। আবার সরকার হয়তো জানেও না, এটি ব্যবহারে স্বাস্থ্যর কী কী ক্ষতি হয় বা এর পরিমাণ কেমন। আর ডায়াগনসিস না থাকায় কতজনের ক্যানসার হচ্ছে বা মৃত্যু হচ্ছে, তার সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা কিছুদিন আগে একটি সেমিনারে বছরে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি কেমন, তা তুলে ধরেছি। আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সেমিনারে আমাদের গবেষণা তুলে ধরছি। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছি। সরকারকে গবেষণা ও তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছি।

শেয়ার বিজ: ২০২১ সালের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশে সব ধরনের অ্যাসবেস্টস ব্যবহার বন্ধ করার বিষয়ে সভায় ক্রিসোটাইল অ্যাসবেস্টসের ক্ষতিকর প্রভাব বিষয়ে গবেষণাসহ অন্যান্য যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে। এখনও বাস্তবায়িত হচ্ছে না কেন? আমরা যদি বলি নেগেটিভ কোনো ইমপ্যাক্ট নেই বলে এর অগ্রগতি হচ্ছে না, তাহলে কি ভুল হবে?

এসএম মোর্শেদ: আসলে নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট যে নেই, বিষয়টি এমন নয়। কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে লম্বা সময় লাগে। এ বিষয়টির আপডেট আমার জানা নেই। এটি মন্ত্রণালয়ের বিষয়। মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিলে জানা যাবে।

শেয়ার বিজ: কোন কোন খাতে অ্যাসবেস্টস ব্যবহার করা হয়? এটি কেমন ব্যয়বহুল? অ্যাসবেস্টসযুক্ত সিমেন্ট শিট ব্যবহারের বিকল্প কি হতে পারে? হলে তা কেমন ব্যয়বহুল হবে?

এসএম মোর্শেদ: অ্যাসবেস্টসযুক্ত সিমেন্ট শিট সাশ্রয়ী না ব্যয়বহুল, তার থেকেও বড় বিষয় হচ্ছে এটি ক্ষতিকর। এর বিকল্প ঢেউটিন। তবে ঢেউটিনের তুলনায় এর লংজিবিলিটি বেশি হওয়ায় মানুষ এটি ব্যবহার করছে। তবে এর বিকল্প আর কী হতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা করা উচিত।

শেয়ার বিজ: বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১ দশমিক ৫ কোটি মেট্রিক টন সিমেন্ট শিট উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতিবছর এর ব্যবহার বাড়ছে প্রায় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকলে প্রতি বছর এর উৎপাদন বৃদ্ধি পেত?

এসএম মোর্শেদ: মানুষ এখনও অ্যাসবেস্টস ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকগুলো সেভাবে জানে না। এর জন্য প্রচুর ক্যাম্পেইন করা এবং সভা-সেমিনার দরকার। বেশি করে এর ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা হলে তখন মানুষ সচেতন হবে। তখন ব্যবহারও কমবে।