Print Date & Time : 24 June 2025 Tuesday 12:23 pm

আইআইডিএফসির খেলাপি লার্ক পেট্রোলিয়াম

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আসলাম চৌধুরীর পারিবারিক মালিকানাধীন রাইজিং গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান লার্ক পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানটি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য ২০১১ সালের ডিসেম্বরে ১০ কোটি টাকা ঋণ নেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (আইআইডিএফসি) থেকে। কিন্তু ধারাবাহিক লোকসান আর অদক্ষতায়, মামলা ও ঋণভারে বিপর্যস্ত রাইজিং গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো লার্ক পেট্রোলিয়ামও। ফলে জানুয়ারি ২০১৫ সালে পুনঃতফসিলকরণ সুযোগ নিলেও বরাবারের মতো ব্যর্থতায় ছয় বছরের সুদাসলসহ বর্তমানে পাওনা দাঁড়ায় মোট ১৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

আইআইডিএফসি সূত্রমতে, বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও ব্যবসায়ী আসলাম চৌধুরীর পারিবারিক মালিকানাধীন রাইজিং গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান লার্ক পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানটি ন্যাচারাল গ্যাস কনডেনসেট ফ্রাকশন প্ল্যান্ট স্থাপন প্রকল্প চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য ২০১১ সালে ১০ অক্টোবর ঋণ জন্য আবেদন করে। আর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইআইডিএফসি পরিচালনা পর্য়দ ১৪০তম পর্ষদ সভায় ঋণ আবেদন গ্রহণ এবং ২০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা প্রদানে অনুমোদন করে। এ অনুমোদনের পর ১১ ডিসেম্বর ২০১১ সালে ১০ কোটি ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু ধারাবাহিক লোকসান আর অদক্ষতায়, মামলা ও ঋণভারে বিপর্যস্ত রাইজিং গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো লার্ক পেট্রোলিয়ামও ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

এতে ২০১৫ সালের জানুয়ারি পুনঃতফসিলকরণ সুযোগ নিলেও তখন প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ কোটি ২৯ লাখ ৮৩ হাজার ১১৫ টাকা। আর তখন থেকে চলতি বছরের ১ অক্টোবর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় মোট সুদের পরিমাণ দাঁড়ায় পাঁচ কোটি ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ৫০২ টাকা। পাশাপাশি অন্যান্য খরচের পাওনা আরও এক কোটি ৮৬ লাখ ৯৬ হাজার ২৩৫ টাকা। এসব পাওনা মিলে লার্ক পেট্রোলিয়ামের কাছে মোট অনাদায় দেনার পরিমাণ ছয় বছরের সুদাসলসহ মোট ১৯ কোটি ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ৮৫২ টাকা পাওনা দাঁড়ায়।

বাণিজ্যিক ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, আসলাম চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যদের প্রচেষ্টায় একে একে কনফিডেন্স শু ফ্যাক্টরি, রাইজিং অ্যাডভান্সড স্টিল মিলস লিমিটেড, রাইজিং স্টিল লিমিটেড, সোনালী শিপব্রেকার্স অ্যান্ড স্টিল লিমিটেড, সেভেন-বি অ্যাসোসিয়েটস (শিপইয়ার্ড), অ্যাকোয়া ফুড লিমিটেড, ফিশ প্রিজারভার লিমিটেড ও কনসেপশন সি ফুড লিমিটেড, লার্ক পেট্রোলিয়াম কোম্পানি লিমিটেড, সোনালী সিএনজি লিমিটেড, চলমান সিএনজি লিমিটেড, পতেঙ্গা রি-ফুয়েলিং ও রাইজিং সিএনজি রি-ফুয়েলিং ইত্যাদি সমন্বয়ে গড়ে ওঠে রাইজিং গ্রুপ।

এ গ্রুপের জাহাজ ভাঙা, ইস্পাত, জ্বালানি ও কৃষিশিল্পের প্রয়োজনের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দিয়ে লাভবান হতে না পেরে বিপাকে পড়েছেন। ক্রমাগত লোকসান-ব্যর্থতা এবং ব্যাংকঋণের দায়ে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল এ গ্রুপের ১৫টিরও অধিক অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। পাওনা আদায়ে ব্যাংকগুলো আদালতের দ্বারস্থ হলে পাওনা আদায়ে চিন্তিত অধিকাংশ ব্যাংক ব্যবস্থাপকরা। যদিও এর মধ্যে গ্রুপটির বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বকেয়া ঋণ এক হাজার কোটি টাকারও বেশি।

এর মধ্যে সাউথইস্ট ব্যাংকের পাওনা ১৪৯ কোটি টাকা। এ অর্থ আদায় করতে গত বছরের মার্চে রাইজিং স্টিলের বিরুদ্ধে মামলা করে ব্যাংকটি। গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সেভেন-বি অ্যাসোসিয়েটসের বিরুদ্ধে মামলা করে পূবালী ব্যাংক। ব্যাংকটির পাওনার পরিমাণ ২১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এবি ব্যাংকের কাছ থেকে ৩২৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ঋণ নেয় রাইজিং স্টিল লিমিটেড। রাইজিং স্টিলের কাছে ইসলামী ব্যাংকের পাওনা রয়েছে প্রায় ১০৫ কোটি টাকা। এ ঋণ আদায়ে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে মামলা করে ইসলামী ব্যাংক। এছাড়া গ্রুপটির কাছে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের আগ্রাবাদ শাখা ও ট্রাস্ট ব্যাংক জিইসি শাখাসহ মোট ১০-১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এক হাজার কোটি টাকারও বেশি পাওনা রয়েছে।

শুধু রাইজিং স্টিল লিমিটেড ও লার্ক পেট্রোলিয়াম কোম্পানি লিমিটেডের কাছে চার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা প্রায় ৫৮৮ কোটি টাকা। এরই মধ্যে পাওনা আদায়ে দি প্রিমিয়ার ব্যাংক, পূবালী, সাউথইস্ট, ইসলামী ও এবি ব্যাংকের মামলায় আদালত একে একে এ গ্রুপের বিভিন্ন সম্পদ নিলামে তুলছে। এদিকে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার হয়ে গত বছরের মে থেকেই কারাগারে আছেন আসলাম চৌধুরী। সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় বেশ কিছু ব্যাংকের দায়ের করা মামলা ঝুলে আছে এ শিল্প গ্রুপটির কর্ণধারদের বিরুদ্ধে। নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ ফেরত না পাওয়ায় পাওনাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় আত্মগোপনে রয়েছেন ওই পরিবারের সদস্যরা, যার প্রভাব পড়েছে গ্রুপটির ২৭টি প্রতিষ্ঠানে। দীর্ঘদিন ধরে লোকসান ও তদারকির অভাবে এরই মধ্যে এ গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। সম্প্রতি এবি ব্যাংকের ৩২৫ কোটি টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় রাইজিং স্টিল লিমিটেডের পরিচালক জসিম উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে চট্টগ্রামের একটি আদালত। তবে তিনি পলাতক রয়েছে বলে জানা যায়।

আইআইডিএফসি’র খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতার হয়ে গত বছরের মে থেকেই কারাগারে আছেন আসলাম চৌধুরী। আর তার পরিবোরের অন্য সদস্যরাও আড়ালে আছেন। ফলে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় খেলাপি ঋণে পরিণত হয় এ প্রতিষ্ঠানের ঋণ। আর এ পাওনা আদায়ে চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে গত মে মাসে বন্ধকিতে থাকা প্রতিষ্ঠানটির পাঁচ কানি জমি নিলামে বিক্রির আয়োজন করি। কিন্তু আগ্রহী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান না পাওয়ায় বিক্রি হয়নি। ফলে আমরা ২২ অক্টোবর অর্থঋণ আদালতে মামলা করি। তিনি আরও বলেন, পাওনাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ায় আত্মগোপনে রয়েছেন ওই পরিবারের সদস্যরা। ফলে দীর্ঘদিন ধরে লোকসান ও তদারকির অভাবে এরই মধ্যে এ গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে জানতে লার্ক পেট্রোলিয়াম কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক আমজাদ হোসাইন চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে মন্তব্য পাওয়া যায়নি।