Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 3:50 pm

আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ার জুয়াড়ি চক্রের নিয়ন্ত্রণে?

শেখ আবু তালেব: মাত্র সাড়ে সাত মাসের ব্যবধানে কোনো ব্যাংকের শেয়ারের দর দ্বিগুণ হওয়ার নজির নেই বললেই চলে। কিন্তু চলতি বছরের ৯ মাসে আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে আয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ঋণের বিপরীতে গত বছরের চেয়ে সাড়ে তিনগুণ বেশি প্রভিশন মুনাফা থেকে কেটে রাখতে হয়েছে। নগদ অর্থ ধার করে চলার পরিমাণ বেড়েছে গত বছরের তুলনায়।

আমানত ও বিনিয়োগের পরিমাণ বিবেচনায় কাছাকাছি থাকা ব্যাংকের শেয়ারের দাম আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ে এখনও অনেক কম। কিন্তু তার পরও এক বছর ধরে শেয়ারটির দর ঊর্ধমুখী প্রবণতায় রয়েছে। এর নেপথ্যে সক্রিয় থেকে একটি জুয়াড়ি চক্র ব্যাংকটির শেয়ারের দর বাড়িয়ে চলেছে। প্রায় আট মাস ধরেই শেয়ারটির বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে চক্রটি। অভিযোগ উঠেছে, চক্রটির নেতৃত্বে থাকা দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক গ্রুপের প্রভাবশালী এক কর্মচারী বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।

বাজারসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চক্রটি পুঁজিবাজারে তথ্য ছড়াচ্ছে এ কথা বলে যে, দেশের প্রতিষ্ঠিত প্রথম সারির করপোরেট প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি, যা বেক্সিমকো নামেই পরিচিত। সাবসিডিয়ারি মিলিয়ে বেক্সিমকোর একাধিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। আইএফআইসি ব্যাংকে বেক্সিমকোর বিনিয়োগ রয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের সব ধরনের শেয়ারের দর বাড়ছে। আইএফআইসির শেয়ারের দরও বাড়বে। এটি বর্তমানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বৃদ্ধি পাবে বলেই গুঞ্জন ছড়াচ্ছে চক্রটি।

জানা গেছে, বেক্সিমকোর এই সুনামকে ব্যবহার করে জুয়াড়ি চক্রটি আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারের দর নিয়ন্ত্রণ করছে। বাজারসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পুঁজিবাজারে ব্যাংকটির শেয়ার নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে অনেক। শেয়ারটির বাজারমূল্য আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবেÑএমন কথা ছড়ানো হচ্ছে। এর মধ্যে শেয়ারদর বৃদ্ধির কিছুটা মিলও পেয়েছেন তারা।

কিন্তু বাজার-সংশ্লিষ্টরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন ব্যাংকটির এমন শেয়ারদর বৃদ্ধিতে। আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারের দরের অস্বাভাবিক এ বৃদ্ধির বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা রক্ষায় বিএসইসি সব সময়ই তৎপর রয়েছে। এক্ষেত্রেও তথ্য সংগ্রহ করা হবে। আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারদরে কোনো অসাধু কাজ হয়ে থাকলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি অ্যাকশনে যাবে।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছরের এই সময়ে ব্যাংকটির শেয়ারদর ছিল অভিহিত মূল্যর একটু ওপরে। ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ১০ টাকা ২৩ পয়সায়। এর পর থেকেই শেয়ারটির দর বৃদ্ধি পায় গত জানুয়ারি পর্যন্ত। সে সময়ে সর্বোচ্চ ১৬ টাকা ৬০ পয়সায় লেনদেন হয়। এরপর আবার শেয়ারটির দর কমতে থাকে। গত ৪ এপ্রিল শেয়ারটির দর অভিহিত মূল্যের নিচে চলে গিয়ে ৯ টাকায় লেনদেন হয়।

এর পর থেকে আবার শেয়ারটির দর বাড়তে শুরু করে। মাঝেমধ্যে শুধু দর সংশোধন হয়। কিন্তু শেয়ারদরে বড় ধরনের কোনো পতন হয়নি। গতকাল শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ২০ টাকা ৩০ পয়সায়। সর্বোচ্চ দর উঠেছিল ২১ টাকা ২০ পয়সা। শেয়ারের বাজারমূল্যের লেনদেন তথ্য ধরে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সাড়ে সাত মাসে আইএফআইসি ব্যাংকের শেয়ারদর বৃদ্ধি পায় ১১ টাকা ৩০ পয়সা বা দুই দশমিক ২৬ শতাংশ।

অথচ ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, এই সময়ে ব্যাংকটির মেয়াদি আমানতের পরিমাণ খুব একটা বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু খেলাপির বিপরীতে মুনাফা থেকে কেটে রাখা নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিকহারে। নতুন করে ১০৮ কোটি টাকা প্রভিশন রাখতে হয়েছে।

কম সময়ের জন্য নেয়া আমানতের বিপরীতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করায় ব্যাংকটির ধার করে চলার প্রবণতা বেড়েছে। সর্বোচ্চ পরিমাণ ধার নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবি থেকে। এদিকে চলতি বছরের ৯ মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নগদ অর্থের চাহিদা মেটাতে চলতি বছরে ব্যাংকটির ধার করার হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংকটির নগদ অর্থের চাহিদা মেটাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে ধার করতে হয়েছিল ২৩৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের ৯ মাসে সেখানে একইভাবে ধার করেছে ৪৩০ কোটি টাকা। এটি প্রায় দ্বিগুণ। এর মধ্যে বেসরকারি ঢাকা ব্যাংক থেকে নিয়েছে ১০০ কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট ৩৩০ কোটি টাকাই নিয়েছে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) থেকে।

জানা গেছে, নগদ অর্থ সংকটের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ। চলতি বছরে ব্যাংকটি এ খাতে পাঁচ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে বছর মেয়াদে দুই হাজার ১৭১ কোটি টাকা। আবার পাঁচ বছরের অধিক মেয়াদে বিনিয়োগ করেছে দুই হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। মেয়াদপূর্তির আগে এই বিনিয়োগ ওঠাতে পারবে না ব্যাংক।

ব্যাংকটির আমানতের দিকে তাকালে দেখা যায়, গত বছরের চেয়ে মেয়াদি আমানতের পরিমাণ খুবই কম বেড়েছে চলতি আমানতের তুলনায়। চলতি বা কারেন্ট হিসাবের বিপরীতে আমানত বেড়েছে বেশি। এসব আমানতের বিপরীতে কোনো সুদ দিতে হয় না ব্যাংকটিকে। ৯ মাসের ব্যবধানে মাত্র ৪০৩ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে মেয়াদি আমানতই বেড়েছে এ সময়ে দুই হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের ৯ মাসের তুলনায় এ বছরের গত ৯ মাসে সুদ আয় বেশি হয়েছে মাত্র আট কোটি টাকা। গত ৯ মাস শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ও রাইটঅফ-সহ সব ধরনের ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ রাখতে হয়েছে ১৪৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। গত বছরের এই সময়ে ব্যাংকটির প্রভিশন সংরক্ষণ ছিল মাত্র ৪১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির প্রভিশন সংরক্ষণের হার বেড়েছে ১০৮ কোটি টাকা বা সাড়ে তিনগুণের বেশি।

ডিএসইর তথ্য বলছে, গতকালও ব্যাংকটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকার, ডিএসইতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন। এটি ডিএসইর মোট লেনদেনের পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকটির ব্যবসায়িক সক্ষমতা খুব একটা বাড়েনি। সুদহার কমে যাওয়া, সরকারি বিল ও বন্ডে ধার দেয়া, ঋণ পুনঃতফসিল ও করোনাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাড় সুবিধা দেয়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি কম রাখতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাড় সুবিধা বাতিল হলে ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।

এজন্য শেয়ারের দর বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ দেখা যাচ্ছে না। গত বছরও ব্যাংকটি বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশ দিতে পারেনি। বিনিয়োগকারীদের মাত্র পাঁচ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে। এ কারণেই ব্যাংকটির শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। ১০ মাস আগে গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারণ ছিল মোটের ২৯ দশমিক শূন্য চার শতাংশ। শেয়ারদর বৃদ্ধির সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

১০ মাসের ব্যবধানে গত অক্টোবর শেষে তাদের শেয়ার ধারণ কমে হয়েছে ২৫ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। এই সময়ে প্রায় চার শতাংশীয় পয়েন্ট শেয়ার ধারণ কমে গেছে। এর বিপরীতে বাড়ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ধারণের হার। গত ডিসেম্বরে যা ছিল ৩৩ দশমিক ৩১ শতাংশ, অক্টোবর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক ২০ শতাংশে। এ বিষয়ে আইএফআইসি ব্যাংকের বক্তব্য জানতে চাওয়া হয় শেয়ার বিজের পক্ষ থেকে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীলরা দেশের বাইরে রয়েছেন বলে জানানো হয়। তাই মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।