Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 2:48 pm

আইএমএফের প্রশ্নের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর উচ্চ খেলাপির জন্য নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি কভিডকালে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে কোন ব্যাংকের কী ধরনের পদক্ষেপ ছিল, সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এক বৈঠকে আইএমএফের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল এসব প্রশ্ন করে। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফরাহ মো. নাছের, নির্বাহী পরিচালক জোয়ার্দার ইসরাইলসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতের ঋণস্থিতি ছিল ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে এক লাখ এক হাজার ১৫০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা বিতরণ করা ঋণের আট দশমিক ১২ শতাংশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাত দশমিক ৬৬ শতাংশ। সে হিসাবে চলতি বছর প্রথম ৯ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা, যদিও প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও বেশি।

কভিড-১৯ মহামারিতে অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় গত বছর ঋণগ্রহীতারা কোনো টাকা পরিশোধ না করলেও তাকে খেলাপি দেখাতে পারেনি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে একরকম ছাড় দিয়ে রেখেছে। এ ছাড়ের কারণে চলতি বছর একজন গ্রাহকের যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তার ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলেও তাকে আর খেলাপি করা যাবে না। এরপরও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আইএমএফ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক ঋণ দিয়েছে দুই লাখ ১৯ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৪৪ হাজার ১৬ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে এসব ব্যাংকের খেলাপি ছিল ৪২ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। নানা ছাড়ের পরও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন আইএমএফ।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, করোনায় ব্যাংক খাতের ক্ষতি ও গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চায় আইএমএফ। এতে ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিংয়ে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না, সে বিষয়েও জানতে চায় সংস্থাটি। মূলধন, সম্পদ, ব্যবস্থাপনা, আয়, তারল্য ও বাজার ঝুঁকিÑএ ছয়টি উপাদানের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক আর্থিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যাকে সংক্ষেপে ক্যামেলস রেটিং বলা হয়।

এছাড়া কভিডকালে সরকারি ব্যাংকগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়। তবে আলোচনায় গুরুত্ব পায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ও প্রণোদনা প্যাকেজ। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং ব্যাংকগুলোর সার্বিক পারফরম্যান্স বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ আসে বৈঠকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর ১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় মেয়াদের প্রণোদনা ঋণ বিতরণ শুরু হলেও কাক্সিক্ষত অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তিন মাস (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পার হয়ে গেলেও দ্বিতীয় মেয়াদে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের হার মাত্র এক থেকে সাত শতাংশের মধ্যে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতে চলতি মূলধন ঋণ হিসেবে প্রথম মেয়াদে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। এর বাস্তবায়ন হার ছিল ৮১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। উল্লিখিত খাতে দ্বিতীয় মেয়াদেও ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করা হয়। ১ জুলাই থেকে প্যাকেজ বাস্তবায়ন শুরু হলেও সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ খাতে বিতরণ হয়েছে মাত্র ৫১৯ কোটি টাকা, যা ঘোষিত প্যাকেজের এক দশমিক ৫৭ শতাংশ।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য চলতি মূলধন ঋণ হিসেবে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে মাত্র ৪৭৭ কোটি টাকা, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার দুই দশমিক ৩৮ শতাংশ।

প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিমের ঘোষণা করা হয়েছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এ প্যাকেজের আওতায় এখন পর্যন্ত সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৬৫টি প্রতিষ্ঠান। এখন পর্যন্ত ৩৭৫ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার সাত দশমিক ৫১ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ বিতরণ করে তা আদায় হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে না। তাই দ্বিতীয় মেয়াদে নতুন ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।

করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় প্রথম মেয়াদে সরকার মোট ২৮টি প্যাকেজ ঘোষণা করে। সবমিলিয়ে এসব প্যাকেজে অর্থের অঙ্ক এক লাখ ৩১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক লাখ তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকার ৯টি প্যাকেজ বাস্তবায়িত হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। বছর শেষে এসব প্যাকেজের সার্বিক বাস্তবায়নের হার ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঝুঁকি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেয় আইএমএফ। এছাড়া নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করে উভয় পক্ষ।