পলাশ শরিফ : বহুজাতিক কোম্পানি মেটলাইফ এখন দেশের শীর্ষ জীবন বীমা কোম্পানি। দেশের জীবন বীমার বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ এখন মেটলাইফের দখলে। বাংলাদেশে কোম্পানিটির গ্রাহক সংখ্যা ১০ লাখ ও বিমা পলিসির সংখ্যা ১২ লাখেরও বেশি। ওই কোম্পানির সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় বিপাকে এদেশের সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর ৪৪ বছর পরও পৃথক কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন, পরিশোধিত মূলধনের শর্তপূরণ ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিসহ বেশকিছু ইস্যুতে বিতর্কের মুখে রয়েছে মেটলাইফ। ‘এজেন্সি অফিস’ হিসেবে নিবন্ধন নেওয়ার সুযোগে দেশের বিদ্যমান বিমা আইন মানছে না কোম্পানিটি।
তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, শীর্ষ কোম্পানি হিসেবে এ দেশের সরকারি-বেসরকারি অন্য জীবন বীমা কোম্পানিগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে মেটলাইফ। বাংলাদেশের জীবন বীমা ব্যবসার প্রায় ৪০ শতাংশ এখন কোম্পানিটির দখলে রয়েছে। এগিয়ে থাকা বহুজাতিক ওই কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বীমা করপোরেশনসহ বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানিগুলো। এদেশের বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর সিংহভাগই এখন মুনাফার টাকায় নিত্যকার ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। ১৯৭৪ সালে ‘আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি’ কার্যক্রম ব্যবসা শুরুর ৪৪ বছরেও বাংলাদেশের বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে অনুমোদন নেয়নি কোম্পানিটি। পৃথক জীবন বীমা কোম্পানি হিসেবে নয়, বরং বহুজাতিক কোম্পানির ‘এজেন্সি অফিস’ হিসেবে অনুমোদন নিয়েই দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করছে মেটলাইফ। কাগজে-কলমে ‘এজেন্সি অফিস’ হওয়ার কারণে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিলুপ্ত বিমা অধিদফতর ও বর্তমান বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) কোম্পানিটির ওপর বিদ্যমান বিমা আইন ও নীতিমালা প্রয়োগ করতে পারছে না।
আলাপকালে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র সদস্য বোরহান উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মেটলাইফ শুরু থেকেই এজেন্সি হিসেবে ব্যবসা করছে। এর আগে আইডিআরএ বহুজাতিক কোম্পানিটিকে বিদ্যমান বিমা আইনের আওতায় আনতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিনা- আমার জানা নেই। আমরা এখনও এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করিনি। ভারতীয় কোম্পানি এলআইসির আদলে মেটলাইফকেও এদেশের আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।’
দায়িত্বশীল সূত্রের তথ্যমতে, বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগে জীবন বীমা ব্যবসা করার জন্য বিদেশিদের হাতে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ শেয়ার থাকতে পারে। বাকি ৪০ শতাংশ শেয়ার দেশীয় উদ্যোক্তাদের কাছে ছেড়ে দিতে হয়। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে ছাড় পেয়েছে মেটলাইফ। এখনও কোম্পানিটির শতভাগ মালিকানা বিদেশি কোম্পানির হাতে রয়েছে। একইভাবে পরিশোধিত মূলধনের শর্তও পূরণ করেনি মেটলাইফ। বিদ্যমান বিমা আইন অনুযায়ী, একটি জীবন বীমা কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৩০ কোটি টাকা হতে হয়। ওই শর্ত পরিপালন না করেও প্রায় ৬৫ বছর ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে মেটলাইফ। এর আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে ওই শর্ত পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পরিপালন করেনি। আইনি জটিলতার কারণে এ বিষয়ে মেটলাইফকে বারবার তাগিদ দিয়েও শর্ত মানতে বাধ্য করতে পারেনি সংস্থাটি।
এদিকে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন না নেওয়ার কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির শর্তও উপেক্ষা করছে মেটলাইফ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মূল কোম্পানি মেটলাইফের (মেট্রোপলিটন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি) শাখা হওয়া ও পরিশোধিত মূলধনের শর্ত পূরণ না করায় মেটলাইফের বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। মূলত বিদ্যমান আইনি জটিলতা-ঘাটতির সুযোগ নিয়েই এখনও পুঁজিবাজারের বাইরে মেটলাইফ।
তথ্যমতে, মেটলাইফের মালিকানার শতভাগ বিদেশি কোম্পানির হাতে থাকায় মুনাফার অংশ হিসেবে প্রতি বছর বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আইডিআরএ’র হিসেবে, গত এক যুগে প্রায় ৮৫০ কোটি টাকা দেশের বাইরে নিয়ে গেছে মেটলাইফ। কিন্তু জীবন বীমা কোম্পানির সলভেন্সি মার্জিন নীতিমালা না থাকায় অর্থ স্থানান্তর প্রক্রিয়া এখনও অস্বচ্ছ রয়েছে। সেসঙ্গে বাংলাদেশে ব্যবসা করে মুনাফা করলেও এখানে বড় বিনিয়োগ করছে না। পুঁজিবাজারে না আসায় কোম্পানির মালিকানা বাংলাদেশিদের হাতে আসছে না। কিন্তু আইন ও নীতিমালাগত জটিলতায় আইডিআরএ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
জানা গেছে, মেটলাইফকে দেশীয় আইন ও নীতিমালার মধ্যে আনতে কয়েক বছর আগে উদ্যোগ নিয়েছিল আইডিআরএ। ওই সময়ে এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। পৃথক কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নেওয়া, পরিশোধিত মূলধনের শর্ত পূরণ ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বিষয়ে কোম্পানিটির দায়িত্বশীলদের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু তাতে সুরাহা হয়নি। বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থার সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে এখনও আইনি কাঠামোর বাইরেই রয়েছে মেটলাইফ।
বাংলাদেশে মেটলাইফের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুরুল ইসলামের সঙ্গে সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে মেটলাইফের কমিউনিকেশন পার্টনারের মাধ্যমে বক্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তিন দিন পেরিয়ে গেলেও তারা কোনো বক্তব্য দেয়নি।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মেটলাইফ জীবন বীমা ব্যবসায় শীর্ষে রয়েছে। নিয়ম মেনে ব্যবসা করছে। যদিও পৃথক কোম্পানি হিসেবে নয়, ‘এজেন্সি অফিস’ হিসেবে অনুমোদন নিয়েছে মেটলাইফ। তাই অন্য বহুজাতিক কোম্পানি বা এলআইসির মতো মেটলাইফও পরিশোধিত মূলধন ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির শর্ত মেনে ব্যবসা করুক- সেটা আমরাও চাই। সেসঙ্গে কোম্পানিটিতে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের অংশীদারিত্বও নিশ্চিত করা উচিত। এখন এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিষয়, এখানে আমাদের কিছু করার নেই। বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে বলে আমার জানা নেই।’
উল্লেখ, প্রায় ৬৫ বছর আগে আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ‘এজেন্সি অফিস’ হিসেবে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে কোম্পানিটি। ১৯৭৪ সালে কোম্পানিটি বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন নিয়ে ব্যবসার পরিসর বাড়ায়। ১৯৯৭ সাল থেকে ব্যবসায়িক দিক দিয়ে বাংলাদেশে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে কোম্পানিটি। মালিকানার সঙ্গে নাম বদলে এখন মেটলাইফ নামে ব্যবসা করছে। কয়েক বছর ধরেই প্রতি বছর গড়ে ১০০ কোটি টাকারও বেশি মুনাফা করছে মেটলাইফ।

Print Date & Time : 30 June 2025 Monday 1:53 pm
আইনের ফাঁকে নিয়ম না মেনেই ব্যবসা করছে মেটলাইফ
পত্রিকা ♦ প্রকাশ: