এবিএম খাইরুল হক: বাংলাদেশ ৩০ লাখ শহিদের আত্মত্যাগ ও চার লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গণপরিষদে গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর এই সংবিধান বলবৎ হয়। এর ১৫৩টি অনুচ্ছেদ। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে সংবিধান বলবৎ করা পর্যন্ত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানগুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় প্যারাগ্রাফে আইনের শাসনের অঙ্গীকার রয়েছে। প্রথম অনুচ্ছেদ বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেছে। সপ্তম অনুচ্ছেদ সংবিধানের প্রাধান্য ঘোষণা করেছে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ঘোষণা করেছে; তৃতীয় ভাগ সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের বিধান করেছে। এই ভাগের ২৬ অনুচ্ছেদ মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। ষষ্ঠ ভাগ সুপ্রিম কোর্টসহ একটি বিচার বিভাগ স্থাপন করেছে। সপ্তম ভাগ একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন স্থাপন করেছে। আইন ও আইনের শাসন প্রক্রিয়া উপর্যুক্ত প্রতিটি ভাগের প্রতিটি অনুচ্ছেদে প্রস্ফুটিত হয়ে রয়েছে। তবে সংবিধান ও আইনের বইতে আইন ও আইনের শাসনের কথা লিপিবদ্ধ থাকা এক জিনিস, আর ওইসব মহান বিধান রাষ্ট্রের বাস্তব প্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত হওয়া সম্পূর্ণ আরেক ব্যাপার।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতিকে হত্যা ও অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা হয়। ২০ আগস্ট সামরিক শাসন জারি প্রভৃতি সবই সংবিধান ভঙ্গ করে করা হয়েছিল। এসব ঘটনা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং আইনের শাসনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। মহান সংবিধান এবং সংবিধানে ব্যক্ত সব বিধান থাকা সত্ত্বেও এই রাষ্ট্রদ্রোহিতা ঘটেছিল। এখানেই শেষ নয়, দেশের রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের প্রায় সবাইকে যারা হত্যা করল, তাদের যেন বিচারের সম্মুখীন হতে না হয়, সেজন্য তদানীন্তন শাসকরা ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর Indemnity Ordinance (ord. No of ১৯৭৫) মারফত বিচারের পথ বন্ধ করে তথাকথিত আইন করে আইনের শাসনের পথ বন্ধ করেন। এই রাষ্ট্র ছিল তখন একটি ঙঃধষরঃধৎরধহ বা স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে আইনের শাসন কথাটিই ছিল এক নিদারুণ রসিকতা। ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর দিবাগত গভীর রাতে কতিপয় সশস্ত্র ব্যক্তি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত হয়ে কারাগারের প্রধান ফটক ও অন্যান্য ফটক খোলার হুকুম দেয়। উল্লেখ্য, রাতে কোনো অবস্থাতেই ফটক খোলা যায় না, অধিকন্তু তাদের কাছে ফটক খোলার কোনো লিখিত অনুমতিপত্রও ছিল না। কারাগার কর্তৃপক্ষ প্রথমে ফটক খুলতে অস্বীকার করলেও পরে বঙ্গভবন থেকে (তাদের বক্তব্য অনুসারে) নির্দেশ পেয়ে তারা সশস্ত্র ব্যক্তিদের দাবিমতো ফটক খুলে দেয়। তৎপর হয়ে তারা বাংলাদেশের চার প্রথিতযশা নেতাকে খুন করে চলে যায়। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় যে, মৌখিক নির্দেশ তা যাদেরই হোক না, কারাগার কর্তৃপক্ষ তা মানতে একেবারেই বাধ্য ছিল না। তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের লিখিত নির্দেশ ব্যতিরেকে ফটক খুলতে পারে না। তা সত্ত্বেও আইন ভঙ্গ করে তারা ফটক খোলে। এভাবেই তারা আইনের শাসন ভঙ্গ করে এবং ফলে জাতি তাদের চারজন নেতা হারায় এবং দেশ আবারও কলঙ্কিত হয়।
তিন ব্যক্তি সংবিধান ভঙ্গ করে পরপর দেশের রাষ্ট্রপতি হলেন। প্রথম দিকে এক পুতুল সংসদ ছিল। দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি সেই সংসদও বাতিল করলেন। তৃতীয় রাষ্ট্রপতি এক ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের মাধ্যমে নিজের গদি পাকাপোক্ত করলেন। সেই সময় সংবিধান ভঙ্গ, আইন ভঙ্গ এবং আইনের শাসন ভঙ্গের প্রতিযোগিতা চলছিল। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল যখন নতুন নির্বাচিত সংসদ অধিবেশনের প্রথম কয়েক মিনিটের মধ্যেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সব অবৈধ রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কার্যকলাপের বৈধতা পঞ্চম সংশোধনী আইনের মারফত প্রদান করা হয়। তারপর তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এক ঘোষণা মারফত পরদিন ৭ এপ্রিল সামরিক শাসন প্রত্যাহার করেন। সংসদ সংবিধানের আওতায় সংবিধানে ব্যক্ত কার্যাবলি করতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলেও অবৈধ রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজের বৈধতা দিতে পারে না, যা অবৈধ তা অবৈধই থাকবে। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। তদানীন্তন সেনাপ্রধান সংবিধান ভঙ্গ করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন, সামরিক শাসন জারি করেন এবং চার বছর ধরে সামরিক শাসন চালু থাকে। সামরিক আদালত প্রাণদণ্ড পর্যন্ত দেয়। সামরিক শাসন চার বছর চলার পর তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ নির্বাচন হলো। আবারও জনগণকে ধোঁকা দিয়ে সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে চার বছরের অবৈধ কার্যকলাপের বৈধতা প্রদান করা হলো। এভাবেই স্বৈরশাসন তাদের আজ্ঞাবহ সংসদকে দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সঙ্গে এবং দেশের সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা করল (committed fraud upon the people of Bangladesh)|
আইনের শাসনের কথা শুধু সংবিধানের পাতায় লেখা থাকলেই হয় না। মুক্তির কথা, স্বাধীনতার বাণী ও আইনের শাসন জনগণের আত্মায় যতক্ষণ না প্রোথিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সংবিধানই তাদের অধিকার হাতে উঠিয়ে দেবে না; সংবিধানে আইনের শাসনের কথা লেখাই থাকলেও সেটি ন্যায়বিচার দেবে না। কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মচারী যদি ফৌজদারি অপরাধ করে তাকেও বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। সবাইকেই মনে রাখতে হবে, ভয় পেতে হবে যে, আইন ভঙ্গ করলে তাকেও শাস্তি পেতে হবে।
ওপরের প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনের শাসনের কথা বলা হয়েছে, কারণ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই আইন ভঙ্গকারীকে, তিনি যত বড় শক্তিশালী ব্যক্তিই হোন না কেন, একই আইনের বিধান অনুসারে শাস্তি ভোগ করতে হবে। ফৌজদারি অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও একই আইনের বিধান অনুসারে একই আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে একই পদ্ধতিতে শাস্তি পেতে হবে, তবে অপরাধ প্রমাণিত না হলে মুক্তি পাবে। যদিও আদালতে বিচারক আইন ভঙ্গকারীর বিচার করে আইনের শাসন সমুন্নত করবেন, কিন্তু তিনি যদি নিজেই আইন ভঙ্গ করেন বা অপরাধ করেন, তবে আইনের শাসন তাকেও ক্ষমা করবে না। আইনের মানদণ্ডে তারও বিচার হবে। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশে একই বিধান। মনে রাখতে হবে, অপরাধী যদি কারও ক্ষতি করে বা কারও বিরুদ্ধে অপরাধ করে, সে যেন মানবজাতির বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করল। এখানেই আইনের শাসনের শ্রেষ্ঠত্ব।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় প্রতিবাদ চলাকালে পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চৌভিন তার হাঁটুর নিচে জনৈক জর্জ ফ্লয়েডের ঘাড় চেপে রাখার ফলে ফ্লয়েডের মৃত্যু ঘটে। বিচারে ডেরেক চৌভিনের সাড়ে ২২ বছর জেল হয়। তাছাড়া মিনেপোলিস কর্তৃপক্ষ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৭ মিলিয়ন ডলার ফ্লয়েড পরিবারকে প্রদান করে। একেই বলে আইনের শাসন। আমাদের দেশেও অনেক সময় প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পুলিশের হেফাজতে আসামির মৃত্যু ঘটার সংবাদ পাওয়া যায়। তাছাড়া নিপীড়ন করে স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ শোনা যায়। অথচ এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে, যা পুলিশ কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট মানতে বাধ্য; অন্যথায় তারা আইন ভঙ্গ করবেন, আইনের শাসন ভঙ্গ করবেন। অনেকে বলেন, এছাড়া আসামিকে বিচারের সম্মুখীন করা দুরূহ বিষয়। কিন্তু এ কোনো যুক্তি হতে পারে না। কোনো কারণেই আইন ভঙ্গ করা যাবে না। প্রয়োজনে অধিকসংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে, তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। তবে তাদের সঠিকভাবে অর্থবহ তদন্ত করতে হবে; কিন্তু জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় যদি করা হয়, তা নিরুৎসাহিত করতে হবে। কারণ প্রথমত, তা আইনের শাসন পরিপন্থি; দ্বিতীয়ত, অন্য কোনো স্বাধীন সাক্ষ্য ব্যতিরেকে শুধু দোষ স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে আদালত খুব কম ক্ষেত্রেই সাজা প্রদান করেন।
এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় মামলা করা হতো এবং তাঁকে নানা জায়গায় ছুটে ছুটে জামিন নিতে হতো। এভাবে তিনি নিজেও ক্রমাগতভাবে আইনের শাসন ভঙ্গের শিকার হতেন। যাতে অন্য কেউ আইনের শাসন ভঙ্গের শিকার না হয়, সে কারণেই হয়তো আমাদের মহান সংবিধানের প্রস্তাবনাতেই আইনের শাসনের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর যখন তিনি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এসেছিলেন, তখন ‘আইনের শাসন’ কায়েম করার ওপরেই সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি নিজেই আইনের শাসনের শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ছিলেন জনগণের একচ্ছত্র নেতা। তিনি তাদের কষ্টের কথা নিজের অন্তরে ধারণ করতেন এবং সে কারণেই তিনি আইনের শাসনের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আমাদেরও উচিত বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বীকৃত আইনের শাসনে বিশ্বাস করা এবং অন্তরে ধারণ করা।
উল্লেখ্য, আইন হচ্ছে, রায়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হলে দায়রা জজকে আইনের বিধান অনুসারে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগে নথি পাঠাতে হয়। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে দায়রা জজরা কঠোরভাবে এই আইন পালন করে আসছেন। উদ্দেশ্য হলো, হাইকোর্ট বিভাগ যেন সংশ্লিষ্ট ডেথ রেফারেন্সটি দ্রুততম সময়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি করতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে আটশ’র অধিক ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। কত-শত আসামি কনডেম্ড সেলে বছরের পর বছর ফাঁসিতে মৃত্যুর অপেক্ষায় রয়েছে, যার চেয়ে অমানবিক ঘটনা আর কী হতে পারে! মৃত্যুর জন্য কনডেম্ড সেলে অপেক্ষমাণ আসামিদের কাছে আইনের শাসন কথাটি হাস্যকর। তেমনিভাবে যদি কোনো বিচারক আইনানুগ কারণ ব্যতিরেকে কোনো মোকদ্দমা শুনানি করতে অনীহা প্রকাশ করেন, বা আংশিক শ্রুত মোকদ্দমা শুনানি সম্পন্ন করতে অহেতুক বিলম্ব করেন, বা শুনানি শেষে রায় না দিয়ে মাসের পর মাস ফেলে রাখেন, তাহলে আইন ভঙ্গ হয় কি না জানি না; কিন্তু অবশ্যই আইনের শাসন ভঙ্গ হয়। তবে এই শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে দেশের জনগণকেও সজাগ থাকতে হবে, যেমন এথেন্সের জনগণ তাদের ম্যাজিস্ট্রেটদের কার্যকলাপের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখত। তারা জানত, বঃবৎহধষ ারমরষধহপব-ই শুধু তাদের অধিকার সমুন্নত রাখতে পারবে, অন্যথায় সম্ভব নয়। এ কথা সব যুগে সব দেশেই প্রযোজ্য। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ক্যাঙারু কোর্টে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যা ছিল আইনের শাসন ভঙ্গের এক চরম লজ্জাজনক উদাহরণ।
শেষ কথা, যে পদ্ধতিতে ধনী-দরিদ্র, শক্তিশালী-দুর্বল, প্রভাবশালী-অক্ষম, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব শ্রেণির মানুষের ওপর সমভাবে ও একই মানদণ্ডে আইন প্রয়োগ করা হয়, সেই পদ্ধতিকেই বলে আইনের শাসন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি
পিআইডি ফিচার