মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ : ইনিশিয়াল পাবলিক অফার বা আইপিও বিজয়ী হবেনÑএমন প্রত্যাশা নিয়ে পুঁজিবাজারে আসছেন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। কারণ প্রাইমারি মার্কেটে লটারি বিজয়ী হতে পারলে অধিক মুনাফার সুযোগ থাকে। তাই এ সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য পুঁজিবাজারে প্রতিনিয়ত আসছে নতুন মুখ। এরই জেরে বাড়ছে বিও অ্যাকাউন্ট। কিন্তু পুঁজিবাজারে এসে কিছুদিনের মধ্যেই হতাশ হয়ে পড়ছেন নতুন বিনিয়োগকারীরা। কারণ আইপিও লটারিতে একাধিক কোটা থাকায় নতুনদের অধিকাংশই বিজয়ী হতে পারছেন না।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ছয় মাসে পুঁজিবাজারে যোগ হয়েছে প্রায় এক লাখ নতুন মুখ। কিন্তু যে প্রত্যাশায় তারা বাজারে এসেছেন সেই প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে না। ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, আইপিও বিজয়ী হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে বাজারে এলেও তা পূরণ হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ আইপিওতে বিভিন্ন কোটা। এই কোটাপ্রথার কারণেই তারা বিজয়ী হতে পারছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
এ প্রসঙ্গে মো. নুরুজ্জামান নামে এক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমাদের মতো সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। কারণ ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্ট অন্য সবার কোটা রয়েছে। ফলে আমরা লটারি বিজয়ী হতে পারছি না।’
পাবলিক ইস্যু রুলস-২০১৫ অনুযায়ী, ফিক্সড প্রাইজ পদ্ধতিতে আইপিও ক্ষেত্রে ইলিজেবল ইনভেস্টরদের (মার্চেন্ট ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, স্টক ডিলার, ইন্স্যুরেন্স, অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ও অলটারনেটিভ বিনিয়োগ ফান্ড প্রভৃতি) জন্য ৫০ শতাংশ। যার মধ্যে ১০ শতাংশ মিউচুয়াল ফান্ড ও অন্যান্য বিনিয়োগকারী ৪০ শতাংশ। সাধারণ বিনিয়োগকারীর জন্য ৫০ শতাংশ। এতে ১০ শতাংশ নন-বাংলাদেশি ও ৪০ শতাংশ অন্যান্য। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ইলিজেবল বিনিয়োগকারীর জন্য ৬০ শতাংশ কোটা রয়েছে। যাতে ১০ শতাংশ মিউচুয়াল ফান্ড ও ৫০ শতাংশ অন্যান্য। আর সাধারণ বিনিয়োগকারীর জন্য ৪০ শতাংশের মধ্যে ১০ শতাংশ নন-বাংলাদেশি ও ৩০ শতাংশ অন্যান্য বিনিয়োগকারী। বিশেষ স্কিমের আওতায় সাধারণ বিনিয়োগকারীর কোটা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীর জন্য ২০ শতাংশ কোটা সুবিধা পেয়ে থাকে। ফলে পুঁজিবাজারে যারা নতুন আসছেন তারা সুবিধা করতে পারছেন না।
তবে বিনিয়োগকারীরা শুধু প্রাইমারি মার্কেটের জন্য পুঁজিবাজারে আসছেনÑএটা মানতে নারাজ বাজারসংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বর্তমানে পুঁজিবাজারে অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। অন্যদিকে মানি মার্কেটের অবস্থা গ্রাহকদের সন্তোষজনক নয়। যে কারণে তারা পুঁজিবাজারমুখী হচ্ছেন। তাদের মতে, শুধু প্রাইমারি মার্কেট নয়, সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগের জন্যও পুঁজিবাজারে আসছেন সাধারণ মানুষ। যার প্রতিফলন পড়ছে বিও অ্যাকাউন্টে।
এ প্রসঙ্গে ডিএসইর সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘বিশ্বের সব পুঁজিবাজারেই উত্থান-পতন আছে। এটা খুবই স্বাভাবিক। এর মধ্য থেকেই বাজার থেকে গেইন করে নেওয়াই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ। তিনি বলেন, আমাদের দেশের জনগণ দিন দিন পুঁজিবাজার বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন। এখন তারা মার্কেটের সামান্য পতনে ভয় পান না। যে কারণে তারা এই বাজারে আসছেন। কেউ যদি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করেন তাহলে তিনি পুঁজিবাজার থেকে ভালো রিটার্ন পেতে পারেন বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ মাসে দৈনিক গড়ে খোলা হচ্ছে প্রায় ৬০০টি নতুন বিও অ্যাকাউন্ট। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জুন শেষে বিও ছিল ২৬ লাখ ৩৬ হাজার ৪৬৫টি। বর্তমানে যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ২১ হাজার ৫২৬টিতে। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে নতুন বিও বৃদ্ধি পেয়েছে ৮৫ হাজারের বেশি। ২০১৬ সালে জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট বিও বাড়ে ৬৮ হাজার। অর্থাৎ আগের বছরের শেষ ছয় মাসের চেয়ে বিদায়ী বছরের শেষ ছয় মাসে বিও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ২২ হাজার।
এদিকে বর্তমানে সারা দেশে পুরুষদের বিও রয়েছে ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৪২৯টি। অন্যদিকে নারীদের বিও রয়েছে সাত লাখ ২১ হাজার ৩৩৯টি। আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে চালু আছে ১১ হাজার ৭৫৮টি বিও। এদিকে মোট অ্যাকাউন্টের মধ্যে দেশি বিনিয়োগকারীদের নামে রয়েছে ২৫ লাখ ৫৪ হাজার ৩৭৯টি বিও। আর প্রবাসীদের বিও সংখ্যা এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৯টি।
বাজারসংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে তালিকাভুক্ত অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের মূল্য আয় অনুপাত রয়েছে বিনিয়োগের অনুকূলে। তাদের দৃষ্টিতে এসব শেয়ার ঝুঁকিমুক্তভাবেই ক্রয় যোগ্য। অন্যদিকে বর্তমানে বাজারে অতিমূল্যায়িত শেয়ার নেই বললেই চলে। যে কারণে এই বাজারের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে সাধারণ জনগণ। তাদের মতে, পুঁজিবাজারে নতুন মুখ যোগ হওয়ার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমে যাওয়া। সুদ কম হওয়ায় ব্যাংক ছেড়ে পুঁজিবাজারমুখী হচ্ছেন তারা। তাদের যুক্তি ভালো কোম্পানিতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করলে লভ্যাংশের মাধ্যমেই ব্যাংক থেকে ভালো রিটার্ন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
উল্লেখ্য, ২০১০ সালের ধসের পর পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ জনগণের অনাগ্রহ তৈরি হয়। ফলে বাজার ছাড়াতে শুরু করেন বিনিয়োগকারীরা। অন্যদিকে সাধারণ জনগণও পুঁজিবাজারমুখী হননি। যে কারণে একেবারে থমকে যায় বিও খোলা। কোনো কোনো হাউজে দিনে একটি বিও ওপেন হয়নি এমন নজিরও রয়েছে। এরপর ২০১২ সাল থেকে ধীরে ধীরে বিও বাড়তে থাকে। পরে আবারও বিও খোলার প্রবণতা থমকে যায়।
এর আগে সময়মতো বিও ফি না দেওয়ায় গত বছর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দেড় লাখের বেশি বিও। সংশিষ্টদের মতে, প্রধানত দুই কারণে এবার অসংখ্য বিও বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে বাজারের মন্দা পরিস্থিতি, অন্যটি প্রাইমারি মার্কেট থেকে বিনিয়োগকারীদের সুবিধা না পাওয়া। যে কারণে বিনিয়োগকারীরা ৫০০ টাকা দিয়ে বিও নবায়ন করেননি। যার ফলে এসব অ্যাকাউন্ট বাতিল হয়ে গেছে।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) ডিপোজিটরি (ব্যবহারিক) প্রবিধানমালা ২০০৩-এর তফসিল-৪ অনুযায়ী, বিও হিসাব পরিচালনার জন্য ডিপোজিটরি অংশগ্রহণকারী বা বিনিয়োগকারীকে নির্ধারিত হারে বার্ষিক হিসাবরক্ষণ ফি দিয়ে হিসাব নবায়ন করতে হয়। এর আগে পঞ্জিকা বর্ষ হিসেবে প্রতি বছর ডিসেম্বরে এ ফি জমা নেওয়া হতো। তবে ২০১০ সালের জুন মাসে বিএসইসি বিও হিসাব নবায়নের সময় পরিবর্তন করে বার্ষিক ফি প্রদানের সময় জুন মাস নির্ধারণ করে। এ সময়ে বিও নবায়ন ফি ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করা হয়। এরপর বিএসইসির জারি করা ২০১১ সালের ১৮ এপ্রিল এক সার্কুলারে ৩০ জুনের মধ্যে বিও হিসাব নবায়নের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। না হলে তা বাতিল করা হবে বলে ওই সার্কুলারে বলা হয়েছিল।