নিজস্ব প্রতিবেদক: আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) ঢাকা কলেরা হাসপাতালে ডায়রিয়ার রোগী প্রতিদিনই বাড়ছে। বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত এ হাসপাতালে ৩৪১ রোগী এসেছেন পেটের পীড়া নিয়ে। কিছুক্ষণ পরপরই অ্যাম্বুলেন্স, ব্যক্তিগত গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে রোগীরা আসছেন। শয্যা সংকুলান না হওয়ায় বাইরে তাঁবু টানিয়ে অস্থায়ীভাবে শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরেই চলছে এ অবস্থা।
চিকিৎসকরা বলছেন, হঠাৎ করে গরম চলে আসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কারণে শিক্ষার্থীদের বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানীয় গ্রহণ এবং অনিরাপদ পানির কারণে ডায়রিয়া রোগী বেড়ে গেছে।
আইসিডিডিআর,বিতে গত মঙ্গলবার এক হাজার ২৭২, বুধবার এক হাজার ২৩৩ এবং বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ১৭৬ রোগী ভর্তি হয়েছেন।
আইসিডিডিআর,বির সহকারী বিজ্ঞানী ডা. শোয়েব বিন ইসলাম বলেন, প্রতি বছর গরমের মৌসুমে দৈনিক গড়ে ৭৫০ থেকে ৮০০ রোগী আসেন এ হাসপাতালে। তবে কয়েকদিন ধরে তা এক হাজার ২০০ ছাড়িয়েছে।
তিনি জানান, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, শনিরআখড়া, মোহাম্মদপুর ও উত্তরা এলাকা থেকে বেশি রোগী আসছেন। রোগীদের বেশিরভাগই কলেরায় আক্রান্ত। এবার ১৮ বছরের বেশি বয়সী রোগী বেশি।
তিনি বলেন, ‘এখানে শিশুরাও আসছে, তবে বয়স্কদের চেয়ে কম। যারা আসছে তাদের মধ্যে তীব্র পানিশূন্যতা দেখা যাচ্ছে।’
ডায়রিয়া বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গরমে অস্বাস্থ্যকর খাবার, পানীয় ও অনিরাপদ পানি পান করায় এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এত দিন বন্ধ থাকার পর একসঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। শিশুরা এত দিন স্কুলে যেত না, বাইরের খাবারও খেত না। এখন বাইরে বের হচ্ছে, বাইরের খাবারও খাচ্ছে। এছাড়া হঠাৎ গরম পড়ে গেছে, মানুষ নিরাপদ পানি পান করছে নাÑএসব কারণে পেটের অসুখ হচ্ছে।’
ঢাকা শিশু হাসপাতালেও রোগীর চাপ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পুষ্টি, লিভার ও পরিপাকতন্ত্র বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শফি আহমেদ।
তিনি জানান, হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৮০০ থেকে এক হাজার শিশু আসে, তাদের ১০ শতাংশই এখন ডায়রিয়ার রোগী। এ বছর ছয় মাসের কম বয়সী শিশুরাও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘এ বয়সী শিশুরা মায়ের বুকের দুধ পান করে। সেজন্য ছয় মাসের কম বয়সী শিশুর ডায়রিয়া সাধারণত হয় না, কিন্তু এবার আমরা এমন রোগীও পাচ্ছি। হাসপাতালে আসছে, চেম্বারেও ডায়রিয়া নিয়ে আসছে অনেকে।’
ডা. শফি আহমেদ বলেন, ‘গরমকালে এমনিতেই ডায়রিয়া বাড়ে। এবার তার সঙ্গে আরও কিছু কারণ যোগ হয়েছে। স্কুল খোলায় শিশুরা বাইরের খাবার বেশি খাচ্ছে। এসব খাবারে ধুলাবালি থেকে যায়। গরমে খাবার, বিশেষ করে ফাস্টফুড পচে যায়। এছাড়া অনিরাপদ পানি খাওয়ার জন্যও ডায়রিয়া হচ্ছে।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে হলে নিরাপদ পানি পান করা সবচেয়ে জরুরি। এছাড়া বাইরের খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।’
রাজধানীর উত্তর কাফরুল এলাকার নির্মাণশ্রমিক নজরুল ইসলাম গত রাতে ভর্তি হয়েছেন আইসিডিডিআর,বিতে। বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার পর পথের ধারের একটি দোকান থেকে শরবত কিনে খেয়েছিলেন। দুপুর থেকেই তার পেট ব্যথা ও পাতলা পায়খানা শুরু হয়। তিনি জানান, পাতলা পায়খানা কোনোভাবেই না কমায় রাতে কলেরা হাসপাতালে চলে আসেন। তখন তাকে ভর্তি করে নেয়া হয়।
মোহাম্মদপুরের শেখেরটেক এলাকার রিকশাচালক জুলহাসকে শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে আইসিডিডিআর,বিতে নিয়ে আসেন তার বন্ধু মকবুল। প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ায় জুলহাস হাঁটতে পারছিলেন না। তাকে হাসপাতালের বেডে নেয়া হয় স্ট্রেচারে করে।
মকবুল বলেন, বৃহস্পতিবার মেসে ভাত খাওয়ার সময় প্লেটে একটি মাছি পড়েছিল। মাছি ফেলে দিয়ে ওই ভাতই খান জুলহাস। পরে সন্ধ্যা থেকেই পাতলা পায়খানা শুরু হয়।
কেরানীগঞ্জ থেকে দুই বছরের শিশু ওয়াজিদ ভূঁইয়াকে নিয়ে তার মা ও নানা এসেছেন আইসিডিডিআর,বির হাসপাতালে। ওয়াজিদের নানা বলেন, ডায়রিয়া হওয়ার পর স্থানীয় চিকিৎসককে দেখিয়েছিলেন, কিন্তু কমছিল না।
রাজধানীর গ্লোরিয়া এলাকার গৃহিণী নিশি দুই বছরের মেয়ে সাফাকে নিয়ে গতকাল ভোরে কলেরা হাসপাতালে আসেন। নিশি জানান, সাফার যমজ ভাইয়ের ডায়রিয়া হয় গত রোববার। তাকে তিন দিন কলেরা হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে হয়েছিল। বৃহস্পতিবার থেকে সাফাও ডায়রিয়ায় ভুগছে।