নিয়াজ মাহমুদ: সব শর্ত মেনেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ইকুইটি এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ফান্ডের (ইইএফ) সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত উদ্যোক্তারা। কিন্তু কোনো ধরনের ব্যবসায়িক যোগ্যতা ছাড়াই কেবল খুঁটির জোরে এ সুবিধা নিচ্ছেন সুবিধাভোগী একটি চক্র। এ চক্রটি এতটাই প্রভাবশালী যে, একই প্রকল্প কাগজপত্র দেখিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ সুবিধা নিচ্ছে। আর এ অনিয়মে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, প্রতারণার মাধ্যমে আইসিবি থেকে ইইএফ বা সমমূলধনি তহবিল সুবিধা পেয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘রয়েস হর্টিকালচার ফারমার্স লিমিটেড’। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ঠাকুরগাঁও শাখার মাধ্যমে ইইএফ তহবিল পাওয়ার জন্য কোম্পানিটি যে জমির দলিল ব্যবহার করেছে, সেটি ছিল একটি বন্ধকি সম্পত্তির দলিল। ইইএফ ঋণ সহায়তা অনুমোদনে এমটিবি ও আইসিবির অবহেলার কারণেই এটি হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে।
গত বছর জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ পরিদর্শন টিম আইসিবির প্রধান কার্যালয়ের নথি পর্যালোচনা করে দেখতে পায়, পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার সিপাইপাড়ায় হলুদ ও মরিচের গুঁড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ইইএফ সুবিধা চান রয়েস হর্টিকালচারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কিরণ শংকর রায়। কিছু শর্তে আইসিবি আট বছর মেয়াদে তিন কোটি ১১ লাখ ৯২ হাজার টাকার ইইএফ সুবিধা মঞ্জুর করে। কিন্তু পাঁচ একর জমি আইসিবিকে দেখালেও একই জমির দলিল এমটিবির ঠাকুরগাঁও শাখাতেই বন্ধকি ছিল। এমটিবিতে একই জমি দেখিয়ে উদ্যোক্তাদের আরেক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসআরএস স্পাইসেস লিমিটেড ঋণ নিয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন অব্যবসায়ীকে হলুদ ও মরিচের গুঁড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের লক্ষ্যে নতুন প্রকল্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের ঐকান্তিক অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ অপেশাদারিত্বের সঙ্গে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ঋণটি অনুমোদন করেছে। পরে কোম্পানিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন সুবিধাও দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিমের বক্তব্য হচ্ছে, আইসিবিকে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে এমটিবির কাছে বন্ধকিকৃত সম্পত্তি ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অগোচরে রয়েসে ফার্টিকালচারের কাছে হস্তান্তরপূর্বক ইইএফ সুবিধা গ্রহণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী সানাউল হকের বক্তব্য জানার জন্য তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুজিব উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ইইএফ ফান্ড মূলত পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখানে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও আইসিবির কোনো এখতিয়ার নেই। পুরো বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক দেখে। আর ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষেই ফান্ডের ব্যবহার করা হয় বলে এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সুপারি চাষ ও প্রক্রিয়াকরণের জন্য রয়েস এগ্রো ফারমার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুপন রায়ের অনুকূলে আইসিবি আট বছর মেয়াদে দুই কোটি ৫৫ লাখ টাকা ইইএফ সুবিধা মঞ্জুর করে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার স্ত্রী রুম্পা রায়। ইইএফ সার্কুলার নং ৩৪ (৯ এপ্রিল ২০১৩) অনুযায়ী, কৃষি আওতাভুক্ত প্রকল্পে একই পরিবারের একাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন করা যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্য করে আইসিবি কোম্পানিটিকে ইইএফ সুবিধা দিয়েছে।
এদিকে মঞ্জুরিকৃত ইইএফ সহায়তার প্রথম কিস্তি ছাড়করণ-সংক্রান্ত অফিস নোটিং থেকে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির নামে পাঁচ একর জমি নামজারি করা হয়েছে। প্রকল্প ভূমি মূল বায়া দলিল নং ২২৫৩ হারিয়ে যাওয়ায় সার্টিফাইড কপি দাখিল করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, বর্ণিত জমির মূল দলিল প্রায় একই সময়ে এমটিবির ঠাকুরগাঁও শাখার কাছে বন্ধকিপূর্বক ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য মালিকের পক্ষে ম্যানেজার সুজন রায় পরিকল্পিতভাবে প্রতারণার উদ্দেশ্যে মূল দলিল হারিয়ে গেছে বলে ঘোষণা করে দলিলের সার্টিফাইড কপি দাখিল করেন।
অন্যদিকে ৩২০৮ নম্বর সাব-কবলা দলিলমূলে ২২টি দাগে মোট পাঁচ একর জমি রয়েস হর্টিকালচার ফারমার্সের নামে হস্তান্তর করা হয়। দাগগুলো হলোÑ১০, ১১, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ২২, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩১, ৩৩, ০৮, ৩৪, ৩৬, ৩৭, ৪১, ৪২। ইইএফ সহায়তা-সংক্রান্ত মঞ্জুরিপত্রের শর্ত পালনের লক্ষ্যে এ হস্তান্তর করা হয় বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে।
রয়েস হর্টিকালচার মালিকদের আরেকটি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসআরএস স্পাইসেস লিমিটেডের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। প্রতিষ্ঠানটিকে হলুদ ও মরিচের গুঁড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ঋণ দিয়ে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছে এমটিবি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের ঐকান্তিক অনুরোধে ওই প্রতিষ্ঠানকে ঋণ সুবিধা দিয়েছে এমটিবির ঠাকুরগাঁও শাখা। পরে প্রতিষ্ঠানটিকে হলুদ ও মরিচের গুঁড়া প্রক্রিয়াজাতকরণের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন সুবিধাও দেওয়া হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
গত বছরের জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ পরিদর্শন টিম কর্তৃক এমটিবির ঠাকুরগাঁও শাখার রক্ষিত নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মেসার্স এসআরএস স্পাইসেস লিমিটেডের (ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুম্পা রায়) নামে ওই শাখায় ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। অন্যদিকে গ্রাহক একই বছরের ৬ জানুয়ারি হলুদ ও মরিচের গুঁড়া উৎপাদনের (প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেট) লক্ষ্যে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার সিপাইপাড়ায় একটি প্রকল্প স্থাপনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন সুবিধাসংবলিত ছয় কোটি ৫৮ লাখ টাকা ঋণের জন্য এমটিবির শাখায় আবেদন করেন। শাখা কর্তৃক ঋণের প্রস্তাব একই বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি এমটিবির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়। অর্থাৎ ব্যাংকের গ্রাহক হওয়ার আগেই গ্রাহকের আবেদনে তা শাখা কর্তৃক মঞ্জুরির প্রস্তাব ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়।
জানা যায়, ঋণ সুবিধাটির মার্কেটিং কর্মকর্তা এমটিবির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইকবাল। ২০১৩ সালের ২৩ জুন এসআরএস স্পাইসেসের বিল্ডিং নির্মাণ এবং প্রকল্পের মেশিনারি ও ইকুইপমেন্ট প্রক্রিয়াকরণের জন্য পাঁচ কোটি টাকার কৃষিজাত মেয়াদি ঋণ মঞ্জুর করে এমটিবি। আর এক কোটি টাকা চলতি মূলধন হিসেবে মঞ্জুর করে। এসআরএস স্পাইসেসের নামে সর্বমোট ছয় কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রাম বিভাগ থেকে চার ধাপে পুনঃঅর্থায়ন করা হয়।
ঋণ মঞ্জুরির শাখার প্রস্তাব ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর উপস্থাপিত মেমো পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন-সংক্রান্ত নথিতে ব্যাংকের এসএমই-সিআরএম বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (সুকমল সিনহা চৌধুরী) প্রতিষ্ঠানটিকে লোন দিতে ফোনে সুপারিশ করেছেন।
একদিকে ঋণ প্রস্তাবনায় গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুম্পা রায়ের অভিজ্ঞতা ১০ বছর এবং প্রকল্পে ৯৩ জন শ্রমিক নিয়োজিত থাকার কথা উল্লেখ করা হলেও এমটিবির কর্মকর্তারা পরিদর্শন দলকে তা দেখাতে সক্ষম হননি। ৯৩ জন লোকবলের স্থলে তিনজন কর্মচারী নিয়োজিত বলে পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী আনিস এ খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বড় ব্যাংক, ছোটখাটো এ ধরনের মিসটেক হতেই পারে। তবে আমরা সব সময়ই সতর্কতার সঙ্গে ঋণ দেই। এর মধ্যেও অনেক সময় গ্রাহক চিনতে বা বুঝতে না পারার কারণে এমনটি হয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
Add Comment