পলাশ শরিফ ও শেখ আবু তালেব: গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে দুটির মধ্যে একটির উৎপাদন বন্ধ। কর-পরবর্তী মুনাফা কমে দুই লাখ টাকায় নেমেছে। রুগ্ণ কোম্পানিটি নতুন ঋণের জন্য ব্যাংকে ধরনা দিয়েও সাড়া পাচ্ছে না। এমন চিত্র মুন্নু জুট স্ট্যাফলার্সের। তারপরও গত তিন মাসে কোম্পানিটির শেয়ারদর প্রায় ৩০২ শতাংশ বেড়েছে। স্বল্প মূলধনি কোম্পানিটির অধিকাংশ শেয়ার নিজেদের হাতে থাকায় কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আকাশ-কুসুম তথ্য ছড়িয়ে শেয়ারদর বাড়িয়েছে।
বেশকিছু সংকটের কারণে উৎপাদন, আয় ও মুনাফা কমছে। কোম্পানিটির শেয়ারদরের সাম্প্রতিক উল্লম্ফনের কারণ খুঁজতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। রাইট বোনাস শেয়ারের মাধ্যমে মূলধন বাড়ানো, ব্যবসা সম্প্রসারণের পর ব্যবসায়িকভাবে ঘুরে দাঁড়ানো ও লভ্যাংশ সম্পর্কে আগাম তথ্য ছড়িয়েই শেয়ারের দর বাড়ানো হয়েছে, যার উল্লম্ফনের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন খোদ ওই গ্রুপের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। এজন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা-পদক্ষেপের গুঞ্জন ছড়ানো হচ্ছে।
অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বৃদ্ধিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কোম্পানির তরফে দৃশ্যমান তথ্য নেই বলে দাবির মুখেও চড়া দামে হাতবদল হচ্ছে শেয়ারটি।
নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মুন্নু গ্রুপের উদ্যোক্তা হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মৃত্যুর পর রুগ্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব এখন তার স্ত্রী-কন্যার হাতে। শীর্ষপদে রদবদলের পর গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট কাটিয়ে ওঠা, চলতি মূলধনের জোগান ও কারখানার আধুনিকায়ন প্রশ্নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না হলেও মুন্নু গ্রুপের কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বাড়ছে। গ্রুপেরই কয়েকজন কর্মকর্তা পরিবার ও স্বজনদের নামে শেয়ার কেনার পর তারাই কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে মনগড়া তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। গুঞ্জনের সঙ্গে বাস্তবতার মিল না থাকলেও ওইসব তথ্যের কারণেই শেয়ারদর বাড়ছে।
অস্বাভাবিকভাবে শেয়ার লেনদেনের অভিযোগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির গড়া তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে একটি সিকিউরিটিজ হাউজকে চিহ্নিত করেছে। এরপর মুন্নু জুট স্ট্যাফলার্সের দর বাড়ার পেছনে গ্রুপটির কয়েকজন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
মুন্নু গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) মোহাম্মদ ফয়েজ মাহফুজ উল্লাহ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মুন্নু জুট স্ট্যাফলার্স নিয়ে আমাদের বেশকিছু পরিকল্পনা আছে। এ কারণে আমরা ব্যাংকঋণের জন্য চেষ্টা করছি। এসব বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। তারপরও আমরা কোনো কিছু চিন্তা করলে, সেটাও বাইরে চলে যাচ্ছে। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার আগেই বাইরের কেউ সেটা নিয়ে কথা বলছে। কীভাবে কী হচ্ছে, কেন দর বাড়ছে, বুঝে উঠতে পারছি না।’
তথ্যানুসন্ধানে মিলেছে, অর্থ সংকটের কারণে ধুঁকছে স্বল্প মূলধনি কোম্পানি মুন্নু জুট স্ট্যাফলার্স। সর্বশেষ আর্থিক বছরে বিতর্কিত কোম্পানিটির কর-পরবর্তী মুনাফা দুই লাখ টাকায় নেমেছে। আর চলতি আর্থিক বছরের ৯ মাসের অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টাকা মুনাফা দেখিয়েছে কোম্পানিটি। মুন্নু জুট স্ট্যাফলার্সের আয়-মুনাফায় গতি ফেরেনি। তারপরও গত এপ্রিলের শুরু থেকে কোম্পানিটির শেয়ারদর বাড়তে থাকে। তিন মাসের ব্যবধানে ওই দর ৮২৩ টাকা ১০ পয়সা থেকে বেড়ে তিন হাজার ৩০৬ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছে।
অস্বাভাবিকভাবে শেয়ারদর বৃদ্ধির কারণে বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা কোম্পানিটিকে তিন দফায় নোটিশ দিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ। আর প্রতিবারই ‘দর বৃদ্ধির পেছনে অপ্রকাশিত মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই’ বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি।
মুন্নু জুট স্ট্যাফলার্সের কোম্পানি সচিব বিনয় পাল এ বিষয়ে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মূলধন বৃদ্ধির পরিকল্পনা ছাড়া আর কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। শেয়ারসংখ্যা কম হওয়ায় দর বৃদ্ধি হচ্ছে বেশি। কারসাজির সঙ্গে কোম্পানির লোকজন জড়িত আছে এমন অভিযোগ সত্য নয়। কোম্পানির কেউই সরাসরি কোনো কারসাজিতে জড়িত নেই। কেউ যদি করে থাকে, সেটি তার ব্যক্তিগত বিষয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের খুঁজে বের করুক। এখানে কোম্পানির কোনো দায় নেই।’
বিশ্বস্ত সূত্রমতে, গ্যাস সংকটের কারণে মুন্নু জুট স্ট্যাফলার্সের একটিমাত্র ইউনিট চালু রয়েছে। গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলএনজি ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হলেও তাতে ব্যয় বাড়বে। অন্যদিকে এ সংকট কাটিয়ে পুরোপুরি উৎপাদনে ফিরতে হলে কারখানার আধুনিকায়ন (বিএমআরই) করতে হবে দুটি ইউনিটেরই। তাতে সময় লাগবে আরও এক বছর। এ হিসেবে সহসাই মুনাফায় ফিরতে পারার সম্ভাবনা নেই কোম্পানিটির। আকাশ-কুসুম পরিকল্পনা ছড়ালেও উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ে এখন পর্যন্ত নতুন কোনো কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়নি। আর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অর্থের জোগান হয়নি। ঋণের জন্য কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ধরনা দিলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কেউই সবুজ সংকেত দেয়নি। তারপরও এসব পরিকল্পনার গুঞ্জনে ভর করে অতিমূল্যায়িত হয়েছে মুন্নু স্ট্যাফলার্সের শেয়ার।
উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটি পাঁচ বছর ধরে নামমাত্র মুনাফা করছে। স্বল্প মূলধনি ওই কোম্পানিটির মোট মাত্র ৪৬ লাখ শেয়ারের ৫৫ দশমিক ৯০ শতাংশ উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে। আর কারসাজির খবরে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর বর্তমানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে কোম্পানিটির ৩৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।