হামিদুর রহমান ও রোহান রাজিব: ফেসবুক ও সার্চ ইঞ্জিন গুগলসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন থেকে প্রতি বছরে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেয়া বিজ্ঞাপনের মূল্য অন্যান্য দেশের তুলনায় একই কি নাÑতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের মতামত চেয়ে গত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠিও পাঠিয়েছে। পাশাপাশি এখন থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনের পেমেন্ট দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে অনাপত্তি সনদ (এনওসি) নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে যাতে দেশের বাইরে বেশি ডলার না চলে যায়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পণ্যের মূল্য যাচাই-বাছাই এবং ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে জানানোসহ আরও অনেক পদক্ষেপে নিয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, সার্চ ইঞ্জিন গুগল, শেয়ার-ইট, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, টিন্ডার, ট্যানট্যান, পিডিএফসহ আরও অনেক জনপ্রিয় অ্যাপ ও সফটওয়্যার বিজ্ঞাপন দেখিয়ে দেশি বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে তা অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক ব্যয় যৌক্তিক কি না তা যাচাই-বাছাই করা জন্য এ উদ্যোগ। সংশ্লিষ্টদের মতে, ফেসবুক, গুগল ও ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপনে আগে যে পরিমাণ ডলার দেশের বাইরে যেত সম্প্রতি বিজ্ঞাপনে ডলার বেশি যাচ্ছে। সে জন্য বিজ্ঞাপনের মূল্য যাচাইয়ের জন্য টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, একটি বিজ্ঞাপনের জন্য কত টাকা পেমেন্ট করতে হবে এর একটা বিলিং ফরমেট থাকা দরকার। সে বিষয়টি উল্লেখ করেও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) জানানো হয়। যেহেতু তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করে, তাই তারা উদ্যোগ নিলে বিলিং ফরম্যাট তৈরি করা যাবে।
অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে সামাজিক মাধ্যমের বিজ্ঞাপনে বেশি অর্থ নিয়ে যাচ্ছে কি নাÑপাশাপাশি এসব পেমেন্টের ক্ষেত্রে বিটিআরসি থেকে এনওসি নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে এই মুহূর্তে বেশি কথা বলার মতো অবস্থা হয়নি। তবে শিগগির আমরা এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে অফিশিয়ালি মিটিং করব। তখন আমরা পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারব।’
অন্যদিকে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবসহ ইন্টারনেটভিত্তিক প্লাটফর্ম ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। ফলে ক্ষুদ্র থেকে বড়Ñসব ধরনের উদ্যোক্তা বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য এখন ঝুঁকছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে। এই বিজ্ঞাপনের পেমেন্টের পরিমাণও দিন দিন বেড়ে চলছে। তবে সে অনুযায়ী দেশে আয় হচ্ছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিজিটাল অ্যাডভারটাইজমেন্ট একটি সেবা খাত। এ খাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। তবে যে পরিমাণ মুদ্রা দেশের বাইরে যাচ্ছে, সেই অনুযায়ী বাংলাদেশের আয় হচ্ছে কি নাÑতার হিসাবের চিত্রও দেখা উচিত।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ডিজিটাল অ্যাডভারটাইজেমন্টও দরকার। কারণ এটার মাধ্যমেও অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হচ্ছে। এ ব্যয়টাও যৌক্তিক। এমন অনেক যৌক্তিক ব্যয় রয়েছে। তবে ডলার সংকটের কারণে আমাদের রিজার্ভ পরিস্থিতি ভালো না। তাই আপাতত এসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা বেশি চলে যাচ্ছে কি না। তার জন্যই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এখনও মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি।
জানা যায়, ফেসবুক ও গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশ কোনো অফিস নেই। বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে থাকে। ওসব এজেন্সি বিজ্ঞাপনের ইনভয়েস তৈরি করে ব্যাংকগুলোর কাছে বিজ্ঞাপন বিল রেমিট করতে পাঠায়। এরপর ব্যাংকগুলো পেমেন্ট করার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিতে হয়। তবে এখন বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমতি দেয়ার আগে বিটিআরসি থেকে অনুমোদন নিতে হবে বলে একটি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এখনও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা বাংলাদেশ ব্যাংককে বলেছি তারা যখন গুগল, মেটাসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম) অনুমোদন দেয় তখন যেন তাদের সব কিছু যাচাই-বাছাই করে দেয়। অনেক সময় আমাদের দেশে নানাভাবে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালানো হয়, ফেক আইডি ওপেন করে নানাভাবে ক্রাইমে জড়িয়ে পড়ে, তখন সোশ্যাল মিডিয়ার এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আমরা কোনো সহযোগিতা বা তথ্য চাইলে তারা আমাদের সহযোগিতা করে না। এটা তো হয় না, তারা আমাদের দেশে ব্যবসা করবে আর আমাদের কথা শুনবে না।
তিনি আরও বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাড়তি টাকা নিচ্ছে কি না এগুলো মনিটরিং করা আমাদের রেগুলার কাজ। আমরা নিয়মিতভাবে বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করছি।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের আগে গুগল, আমাজান, ফেসবুক ও ইউটিউবের বিজ্ঞাপন থেকে সরকার কোনো শুল্ক আদায় করত না। পরে ২০১৯ সালের এপ্রিলে গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবের মতো ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ থেকে দেয়া বিজ্ঞাপনের লেনদেন থেকে সব ধরনের রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই ভ্যাট আদায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি চিঠি দিয়েছিল এনবিআর। পরবর্তীকালে এনবিআরের নির্দেশ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের নির্দেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে থেকে সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহণকারীর কাছ থেকে মূসক (ভ্যাট) আদায় নিশ্চিত করতে হবে। ‘মূল্য সংযোগ কর আইন, ১৯৯১’-এর ধারা-৩-এর উপধারা (৩)-এর দফা (ঘ) অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে থেকে সেবা (যেমন-রয়্যালটি, বিভিন্ন ইন্টারনেট সার্ভিস, ফেসবুক, ইউটিউবসহ সব মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার প্রভৃতি) সরবরাহের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহণকারীর কাছ থেকে ১৫ শতাংশ হারে মূসক আদায়যোগ্য।
এনবিআর সূত্রমতে, ওই সময়ে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ভ্যাট নেয়া সম্ভব হয়নি। অনিবাসী হিসেবে নিবন্ধন নেয়ার ক্ষেত্রে নতুন মূসক আইন জটিলতা তৈরি করে। তবে দুই বছর চেষ্টার পর এনবিআর অনিবাসী নিবন্ধন দেয়া শুরু করে। প্রথম অবস্থায় ২০২১ সালের ২৩ মে নিবন্ধন দেয়া হয় বিশ্বের অন্যতম টেক জায়ান্ট গুগলের দুটি প্রতিষ্ঠানকে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট ও সফটওয়্যার সেবাদানকারী বহুজাতিক কোম্পানি গুগল দুটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেয়। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো গুগল এশিয়া প্যাসিফিক লিমিটেড ও গুগল আয়ারল্যান্ড লিমিটেড। ২৭ মে নিবন্ধন নেয় আমাজন ওয়েব সার্ভিস লিমিটেড। ১৬ জানুয়ারি তিনটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেয় ফেসবুক। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো ফেসবুক আয়ারল্যান্ড লিমিটেড, ফেসবুক পেমেন্টস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও ফেসবুক টেকনোলজিস আয়ারল্যান্ড লিমিটেড।