রহমত রহমান: দেশের অন্যতম স্থলবন্দর আখাউড়া। ঢাকা থেকে এ বন্দরে যেতে সময় লাগে মাত্র সোয়া তিন ঘণ্টা। যেখানে বেনাপোল যেতে লাগে সাড়ে ছয় ঘণ্টা। দিল্লি, চেন্নাই, মুম্বাইগামীদের এ বন্দর ব্যবহারে সময় আর অর্থ দুটোই সাশ্রয় হয়। শুধু যাত্রী গমনাগমন নয়, পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়। ফলে রপ্তানিকারকদের পছন্দের বন্দর হয়ে উঠছে আখাউড়া। স্থলবন্দরটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে আগামী ২০ বছরের উপযোগী মহাপরিকল্পনা ‘মেগা প্ল্যান’ তৈরি করা হচ্ছে।
এ বন্দরটি অন্য বন্দরের চেয়ে ব্যতিক্রম রপ্তানির জন্য। এ বন্দর সীমান্তের ওপারের মানুষের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কয়েকটি কারণে। এর মধ্যে অন্যতম হলো বাংলাদেশি পণ্য তুলনামূলক সস্তা, পরিবহন খরচ ও সময় কম লাগে। ফলে এ বন্দর দিয়ে প্রায় ৩১ ধরনের পণ্য ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে, বাড়ছে রাজস্ব আহরণ। সম্ভাবনার ক্ষেত্র হয়ে ওঠা আখাউড়া বন্দরের উন্নয়ন, যাত্রীসেবার মান ও এ বন্দরে আন্তর্জাতিক চেকপোস্টে রূপান্তরের মেগা প্ল্যান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে কুমিল্লা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট। সম্প্রতি বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিজিবি, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
ওই সংলাপে কুমিল্লা ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন। সভায় মেগা প্ল্যান তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এ প্ল্যান বাস্তবায়িত হলে আখাউড়া উড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আখাউড়া স্থল শুল্কস্টেশন সূত্র জানায়, এ বন্দর দিয়ে ভারতে প্রায় ৩১ ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো পাথর, সিমেন্ট, তাজা মাছ, শুঁটকি, প্রাণ ফুড, ড্রিংকস ম্যাংগো, লিচি ড্রিংকস, প্লাস্টিক হাউজহোল্ড আর্টিক্যালস, পিভিসি পাইপ, ডোর প্যানেল ও ফ্রেম, পিভিসি ডোর, পাটের সুতলি, ডিফর্মড বার, মেলামাইন পণ্য, স্টিল শিট ইন কয়েল, ওয়াটার ট্যাংক, প্লাস্টিক ফার্নিচার, নিটেড অর করকেটেড ফ্রেবিক্স, কয়লা, পাম্প লিফটিং ফর রিভার ওয়াটার, টুস্ট অ্যান্ড কেক ও বিস্কুট, নুডলস, পামওয়েল, সয়াবিন ওয়েল, ক্যালসিয়াম কার্বনেট, গ্লাস টেবিলওয়্যার, থ্রেসিং মেশিন, ট্রান্সফরমার, হ্যান্ড পাম্প, ইডিবেল জেল, লিচি ড্রিংক, পটেটো পেলেটস, কমপাউন্ড এটিমেল (পোলট্রি ফিড), আইস পপ, জার কাপ, মেটাল ফার্নিচার, ও প্রিপ্রিন্ডটেড গ্ল্যালভানাইজিং স্টিল শিট প্রভৃতি। এছাড়া প্রতিনিয়ত রপ্তানির তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য।
আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশনের হিসাবে, বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছর এ স্টেশন দিয়ে মোট পণ্য রপ্তানি হয়েছে এক লাখ ৪১ হাজার ৬৪৭ মেট্রিক টন। যার মূল্য প্রায় ৫৪২ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর রপ্তানি হয়েছে দুই লাখ ৯ হাজার ৯৬২ মেট্রিক টন, যার মূল্য প্রায় ৩৩২ কোটি টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছর রপ্তানি হয়েছে দুই লাখ ১১ হাজার ৫১৭ মেট্রিক টন, যার মূল্য প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছর করোনার কারণে পণ্য রপ্তানি কিছুটা কমেছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি বাড়ছে।
বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছর ভারত থেকে দেশে এসেছে ৯৭ হাজার ৩২৮ জন যাত্রী। আর ভারতে গেছেন এক লাখ ২৫ হাজার ৫২২ জন। ভ্রমণ কর আদায় হয়েছে ছয় কোটি ২৮ লাখ টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর ভারত থেকে যাত্রী এসেছে ৯১ হাজার ৭৭৫ জন। আর ভারতে গিয়ে এক লাখ ২৬ হাজার ৫৩২ জন। ভ্রমণ কর আদায় হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
আমদানির চিত্রে দেখা যায়, বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছর মাত্র সাড়ে ৬৬ মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ আমদানি হয়েছে। যার মূল্য প্রায় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা। ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর আমদানি হয়েছে ৯৭.৩ মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ, মরিচ, চাল ও ফুলের ঝাড়ু। যার মূল্য প্রায় ৮৭ লাখ টাকা। রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ২৯ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছর আমদানি হয়েছে ১০৩ মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ। যার মূল্য প্রায় এক কোটি ৭৬ লাখ টাকা। রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৬১ লাখ টাকা।
কমিশনার মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী জানান, ঢাকা থেকে আখাউড়া বাসে ও ট্রেনে কম খরচে আসা যায়। ঢাকা থেকে আখাউড়া ১৩০ কিলোমিটার আর বেনাপোল ২৪৩ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে আখাউড়ায় যেতে সময় লাগে সোয়া তিন ঘণ্টা ও বেনাপোলে যেতে সাড়ে ছয় ঘণ্টা।
তিনি বলেন, ভ্রমণকারীরা দিল্লি, চেন্নাই, মুম্বাই গেলে আগরতলা হয়ে যান। ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে আগরতলা এয়ারপোর্ট মাত্র ৮ কিলোমিটার সময় লাগে ২০ মিনিটের কম। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব কুমার দেবের আদি বাড়ি কুমিল্লায়। আগরতলায় জীবনযাত্রার ব্যয় কম। আতিথেয়তা ও সমাদরে আগরতলা অনেক আন্তরিক। চিকিৎসাগামীদের জন্য দিল্লি, চেন্নাইয়ের ফ্লাইট সস্তা। চিকিৎসার জন্য যারা যান, তাদের জন্য সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী।
কমিশনার আরও বলেন, আমদানিনির্ভর পণ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপ বা দূরপ্রাচ্যের দেশের তুলনায় ভারত থেকে ভাড়া ও সময় কম লাগে। দু’দেশের যৌথ প্রকল্প ও প্রথাগত কারণে যাত্রী যাতায়াতও বেড়ে গেছে। এসব আমদানিকারক ও যাত্রীদের জন্য বেনাপোল, ভোমরা, দর্শনা, সোনামসজিদ, হিলি, বুড়িমারী ইত্যাদির মধ্যে আখাউড়াকে আদর্শ চেকপোস্ট করার জন্য মেগা প্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে। এ মেগা প্ল্যানের আওতায় পরিকল্পনা প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক মানের চেকপোস্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা, যাত্রী ও কার্গো ব্যবস্থাপনা খরচ ও সময় সাশ্রয়ী করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রথমে যাত্রী সুবিধা নিশ্চিতকরণ এবং পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
এ বিষয়ে কাস্টমসের করণীয় বিষয়ে কমিশনার বলেন, সব এজেন্সির সমন্বয়, মেগা প্ল্যান তৈরির প্রাথমিক আয়োজন, যাত্রীদের দ্রুত সেবাদান সমন্বয় ও ত্বরান্বিতকরণ, আমদানি পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অবাধকরণ এবং প্রস্তাবনা তৈরি করে এনবিআরে পাঠানো হবে।
সভায় স্থলবন্দরের করণীয় বিষয়ে বলা হয়, আগামী ২০ বছরের উপযোগী পরিকল্পনা তৈরি, যাত্রী ও কার্গো সেবার অবকাঠামো তৈরি, আধুনিক যাত্রী হ্যান্ডলিং ভবন তৈরি, প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট আমদানি ও প্রস্তুতি গ্রহণ, বর্তমান কার্গো সেবার জন্য ফর্কলিফট ও সরঞ্জাম সংগ্রহ, যাত্রী স্ক্যানার স্থাপন, দুটো ওজন পরিমাপক যন্ত্র স্থাপন এবং বিদ্যমান ব্যবস্থাপনায় যাত্রীদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করা হবে। বিজিবির করণীয় বিষয়ে বলা হয়, যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত সতর্ক নজরদারি, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও চোরাচালান, নিষিদ্ধ, অবৈধ পণ্য ও ব্যক্তি প্রবেশে প্রযুক্তি ও সনাতন নজরদারি বৃদ্ধি।