সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম : ব্যবসার প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ সময়মত পরিশোধ করতে না পারায় চট্টগ্রামের ৬৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৬৭টি মামলা করে। আর পাওনা আদায়ে ৩২টি মামলা করে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। মামলার তালিকায় আছেন চট্টগ্রামের একাধিক শীর্ষ ব্যবসায়ীসহ পাইকারি ব্যবসায়ী। আর পাওনা আদায়ে চিন্তিত অধিকাংশ ব্যাংক ব্যবস্থাপক।
ব্যাংক ও অর্থঋণ আদালত সূত্রে জানা যায়, ভোজ্যতেল আমদানিকারক, আবাসন নির্মাতা, পোশাক উৎপাদন ও জাহাজ ভাঙা শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের পাইকারি পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হতে ঋণ নিয়ে সময়মত পরিশোধ করতে না পেরে খেলাপি হয়ে পড়েন চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী। আর এসব খেলাপি ঋণ আদায়ে চলতি বছরের আগস্টে চট্টগ্রামের ৬৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ৬৭টি মামলা করে।
মামলার রেজিস্টার বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাওনা আদায়ে সবচেয়ে বেশি মামলা করে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটির বিভিন্ন অফিস মিলে মোট ৩২টি মামলা করে। তারপর সাত মামলা করে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সরকারি অগ্রণী ব্যাংক। তিন মামলা করে তৃতীয় অবস্থানে ন্যাশনাল হাইজিং ফাইন্স্যাস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড। পাশাপাশি জনতা, বেসিক, উত্তরা, এবি, এনসিসি, মার্কেন্টাইল, ইউসিবিএল ব্যাংক এবং আইডিএলসি এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রত্যেকে দুটি করে মোট ১৬টি মামলা করে। এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড চ্যার্টার্ড, ন্যাশনাল, ঢাকা, রূপালী, ওয়ান, ইস্টার্ন, সাউথইস্ট, ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, আইএফডিসি প্রত্যেকে একটি করে মোট ৯ মামলা করে। তবে এসব মামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত চট্টগ্রামভিত্তিক ইস্পাত মডার্ন স্টিল মিলস লিমিটেড। এ প্রতিষ্ঠানটির কাছে সুদ ও আসল মিলে জনতা ব্যাংকের গত ২০ আগস্ট পর্যন্ত মোট পাওনা দাঁড়ায় ৪০৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এসব পাওনা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে জনতা ব্যাংক একটি মামলা করে।
বর্তমান ব্যাংক খাতের বহুল আলোচিত ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান ক্রিস্টাল গ্রæপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপব্রেকিং লিমিটেড। বেসিক ব্যাংক লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখা অফিস জানায়, এ প্রতিষ্ঠানের কাছে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত পাওনা (সুদসহ) দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। পাওনা আদায়ের বিষয়ে বিভিন্ন সময় জানানো হলেও প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ বারবার সময়ক্ষেপণ করেছে। ফলে বেসিক ব্যাংক লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ২৮ আগস্ট চট্টগ্রামে অর্থঋণ জর্জ আদালতে মামলা করে। একইভাবে ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখাও দেশের অন্যতম শিল্প গ্রæপ মোস্তফা গ্রæপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মোস্তফা পেপার কমপ্লেক্স লিমিটেডের কাছে পাওনা আছে ১৪৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এ ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটি ঋণখেলাপিতে পরিণত হয়। আর এ পাওনা আদায়ে গত ২০ আগস্ট ন্যাশনাল ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা মামলা করে। পাশাপাশি পটিয়া উপজেলায় হালিমকর চর মৌজায় প্রায় ১২ একর জমি ব্যাংকের কাছে বন্ধক থাকা সম্পত্তি নিলামে বিক্রির জন্য তোলে। কিন্তু কোনো আগ্রহী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান না থাকায় এ সম্পত্তি বিক্রি করতে পারেনি ব্যাংক।
মামলার বাদী ব্যাংকগুলো একাধিক শাখা ব্যবস্থাপক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো যোগাযোগ ও নির্দিষ্ট সময় অনুসরণ না করায় আমরা মামলা করেছি। এসব পাওনা আদায়ে খুব চিন্তিত আছি।’
বেসিক ব্যাংক লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখার জিএম মো. আবুল কালাম আজাদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মেসার্স ক্রিস্টাল স্টিল অ্যান্ড শিপব্রেকিং লিমিটেডের মালিক মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও সাড়া পায়নি। এদিকে নিলামেও কোনো বন্ধকি সম্পত্তি কিনতে আগ্রহী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়নি। ফলে আমরা মামলা করেছি।’
ব্যাংক, ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংক ঋণের সুদ বেশি, ব্যবসায়িক অদক্ষতা, টানা লোকসান, ব্যাংকের দায় পরিশোধে ব্যর্থতা ও আন্তর্জাতিক বাজারে ধারাবাহিক দরপতনের কারণে ব্যবসায়ীদের এমন অবস্থা। একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বলেন, ব্যাংক যদি আমাদের আবারও ঘুরে দাঁড়াতে সহযোগিতা করে, তাহলে আমরা এ ঋণ পরিশোধ করতে পারব। কারণ, ব্যবসায় তো উত্থান-পতন থাকবে।
মোস্তফা গ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির উদ্দিন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ কাটিয়ে উঠতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকৃত ব্যবসায়ীদের দীর্ঘমেয়াদি সুদ আরোপ স্থগিত করে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি নতুনভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে। পাশাপাশি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে গুণগত মান, সঠিক ব্যবসায়ী যাচাই, এক খাতে একাধিক ব্যবসায়ীকে ঋণ না দেওয়া, কৃষি ও উৎপাদনমুখী খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণদান বিবেচনা করতে হবে। এছাড়া নতুন ব্যাংকের নিবন্ধন না দেওয়াসহ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ঋণ গ্রহণের ক্ষমতা সীমিত করা।’
Add Comment