ইসমাইল আলী: গ্যাস সংকটে বসিয়ে রাখা হয়েছে তিন হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে তেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। তবে জ্বালানি তেলের দামও বেড়ে চলেছে। এ কারণে চলতি অর্থবছর বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম দ্রুত না বাড়ালে আগামী অর্থবছর তা আরও বাড়বে বলে শঙ্কা করছে সংস্থাটি।
সূত্রমতে, লোকসানের বোঝা কমাতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা চলছে। গত বছর নভেম্বরেই এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) জমা দেয় পিডিবি। সে প্রস্তাবে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে এখনও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শুনানির তারিখই চূড়ান্ত করেনি বিইআরসি। আগামী রোজায় তার সম্ভাবনাও কম।
কবে নাগাদ বিদ্যুতের দাম বাড়বে, তা নিয়ে সংশয়ে আছে পিডিবি। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আগামী অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেট প্রস্তুতি বৈঠকে লোকসানের বিস্তারিত তুলে ধরে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরের লোকসান ও ভর্তুকির সংশোধিত হিসাব তুলে ধরা হয়। এছাড়া আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রস্তাবনায়ও পিডিবির সম্ভাব্য লোকসান ও ভর্তুকির হিসাব তুলে ধরা হয়। যদিও গ্যাস ও ফার্নেস অয়েলের দাম বাড়লে লোকসান আরও বৃদ্ধির শঙ্কা করা হচ্ছে।
সভায় জানানো হয়, গত অর্থবছর (২০২০-২১) এ লোকসানের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। তবে বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোয় এবং গ্যাসের স্বল্পতা ও ফার্নেস অয়েল-ডিজেলের দাম বাড়ানোয় ফলে চলতি (২০২১-২২) অর্থবছর পিডিবির লোকসান প্রাক্কলন করা হয়েছে ২৬ হাজার ৮৩৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর পিডিবির লোকসান প্রায় ১৩১ শতাংশ বেড়ে যাবে।
এদিকে আগামী অর্থবছরের (২০২২-২৩) জন্য ২৭ হাজার ৩৯৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা লোকসান প্রাক্কলন করেছে পিডিবি। আর ভর্তুকির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২২ হাজার ৭৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এতে ভর্তুকির পরও ঘাটতি দাঁড়াবে পাঁচ হাজার ৩১৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের জন্য পিডিবির পক্ষ থেকে ভর্তুকি (সংশোধিত) চাওয়া হয়েছে ২৪ হাজার ৮৭৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। তবে অর্থবছরের শুরুতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাজেটে ভর্তুকি ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৫৩৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর ভর্তুকির প্রয়োজন বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণের বেশি।
সভায় উত্থাপিত তথ্যমতে, গত অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২১ হাজার ৭৮০ মেগাওয়াট। চলতি অর্থবছর তা ২৩ হাজার ১২২ ও আগামী অর্থবছর ২৬ হাজার ৬২২ মেগাওয়াট দাঁড়াবে। আর গত অর্থবছর নিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল সাত হাজার ৮৬৫ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। চলতি অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়াবে আট হাজার ৪৯৬ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৯ হাজার ১৭৯ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা।
তথ্যমতে, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বেসরকারি খাত কেনা, ভারত থেকে আমদানি ও অন্যান্য খাত মিলিয়ে পিডিবির চলতি অর্থবছর সম্ভাব্য মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৬৯ হাজার ৯৩৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আর বিদ্যুৎ বিক্রি ও অন্যান্য খাত মিলিয়ে সংস্থাটির মোট আয় দাঁড়াবে ৪৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছর পিডিবির সম্ভাব্য মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৭৩ হাজার ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। আর বিদ্যুৎ বিক্রি ও অন্যান্য খাত মিলিয়ে সংস্থাটির মোট আয় দাঁড়াবে ৪৫ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে সভায় উপস্থিত পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চলতি ও আগামী অর্থবছরের জন্য লোকসানের সম্ভাব্য হিসাব করা হয়েছে গ্যাস ও তেলের ফেব্রুয়ারির মূল্য ধরে। তবে এরই মধ্যে ফার্নেস অয়েলের দাম লিটারে ১৪ টাকা বেড়ে গেছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়াও চলছে। ফলে প্রকৃতপক্ষে লোকসান আরও বেশি হতে পারে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হলে লোকসানের বোঝা কমবে।
যদিও সম্প্রতি বিদ্যুতের দাম বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এজন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। গত ২৪ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সরকার চাচ্ছে বিদ্যুতের দাম বাড়লেও তা যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। তিনি আরও বলেন, ‘রাষ্ট্র বা সরকার বিদ্যুতে বিনিয়োগ করবে এ জায়গাটা স্থিতিশীল রাখার জন্য। তবে এটার একটা শক্ড প্রাইস আছে, সরকার কতটুকু নিতে পারবে। এটা সরকারের অর্থ বিভাগ বুঝবে। আমাদের তো একটা প্রস্তাবনা আছে। তারা (অর্থ বিভাগ) যদি বলে সব শক্ড নেবে, তাহলে তো এখানে কোনো প্রশ্ন আসে না। যদি বলে ফিফটি ফিফটি শক্ডটা দেব (অর্ধেক ভর্তুকি দেব), তাহলে আরেক রকম প্রশ্ন আসবে। এটা নির্ভর করে ফাইন্যান্সের (অর্থ বিভাগ) ওপর, আমাদের ওপর নয়।’