নিজস্ব প্রতিবেদক: আগামী বছর থেকে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতারা ই-চালানে (ইলেকট্রনিক ট্রেজারি চালান) কর প্রদান করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তিনি বলেন, আগামী বছর থেকে ই-চালান বাধ্যতামূলক করা হবে। বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) সেগুনবাগিচায় এনবিআর সম্মেলন কক্ষে ভ্যাট ই-পেমেন্ট সিস্টেম এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
ই-চালান বিষয়ে তিনি বলেন, অর্থ বিভাগ একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করছে। যাকে তারা বলছে ই-চালান। এর মাধ্যমে যে কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারিতে টাকা জমা দিতে পারবেন। জমার একটি ইলেট্রনিক ট্রেজারি চালানও পাবেন। প্রথম দিকে সাধারণ চালানের মতোই একটি চালান পাবেন, যাতে সিকিউরিটি বারকোড থাকবে। আমরা অর্থ সচিবের সাথে বৈঠক করেছি। আমরা প্রথম অবস্থায় ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের জন্য ই-চালান চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তিনি বলেন, এ বছর কর অঞ্চল-৪, ঢাকায় প্রাথমিকভাবে পাইলটিং করা হবে। এ কর অঞ্চলের করদাতারা ই-চালানের মাধ্যমে কর পরিশোধ করার সুযোগ পাবেন। জমার সাথে সাথে একটি কনফারমেশন নাম্বার আসবে। সে নাম্বার যাচাই করলে দেখা যাবে তা বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারিতে জমা হয়ে গেছে। পাইলিং সফল হলে আমরা এর বিস্তার করবো। আগামী বছর থেকে ই-চালান বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করবো।
ই-পেমেন্ট ভ্যাট আহরণের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন,নতুন মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার অংশ হিসেবে করা হয়েছিল। কিন্তু এ আইনটির মুল ভিত্তি ছিল অটোমেশন। আর আইন বাস্তবায়নে অনলাইনভিত্তিক অবকাঠামো তৈরিতে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। আইন বাস্তবায়ন কিছুটা পিছিয়ে যাওয়ার কারণেই প্রকল্পটি একটু ঝিমিয়ে চলছিল। প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১ জুলাই ২০১৯ আইনটি বাস্তবায়ন শুরু হয়। আইন বাস্তবায়নের পর থেকে বিভিন্ন মডিউল বাস্তবায়ন করা শুরু হয়েছে।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, নতুন আইনের সফল বাস্তবায়নের জন্য ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে আইভাস চালুর কার্যালয় হাতে নেয়া হয়েছে। আইভাস এর ১৬টি মডিউলের মধ্যে ইতোমধ্যে রেজিস্ট্রেশন, রিটার্ন ও ট্যাক্সপেয়ার একাউন্ট মডিউল তিনটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মডিউলগুলি বাস্তবায়ন করা হবে।
তিনি বলেন, রেজিস্ট্রেশন মডিউলটি অনলাইনভিত্তিক করায় ইতোমধ্যে এক লাখ ৬৬ হাজার ৭২০জন করদাতা অনলাইনে বিআইএন গ্রহণ করেছেন। এছাড়া ২০১৯ সালের অক্টোবর হতে অনলাইনভিত্তিক রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ৪২ হাজারেরও বেশি করদাতা অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছেন। সকল নিবন্ধিত ও তালিকাভুক্ত ব্যক্তি যাতে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করতে পারে সে লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, কিছুদিন পর হয়ত আমরা চিন্তা করবো অনলাইন ভ্যাট রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার। আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক করার আগে আমাদের প্লাটফর্ম তৈরি করতে হবে। সিস্টেমের ত্রুটি-বিচ্যুতি শেষ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীতে অনলাইনভিত্তিক কিছু কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে ই-পেমেন্ট উদ্বোধন করা হচ্ছে।
ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছর শেষ হচ্ছে। মেয়াদ বাড়ানো হবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ৪টি মডিউল শেষ হয়েছে। আরও ১২টি মডিউল শেষ করার জন্য প্রয়োজনে প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানো হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্নিমাণের ঘোষণা বাস্তবায়ন এবং অন্যদিকে পরিপালন খরচ কমিয়ে ব্যবসার উন্নতি সূচকে বাংলাদেশকে অনেক এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে চালু হচ্ছে ই-পেমেন্ট মডিউল। ইতোমধ্যে ই-পেমেন্ট মডিউলটির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ভ্যাট সংক্রান্ত সকল কর (ভ্যাট, টার্নওভার কর, সম্পূরক শুল্ক, জরিমানা, সুদ ইত্যাদি) ই-পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করে পরিশোধ করতে পারবেন।
বর্তমানে এইচএসবিসি, প্রাইম ও মিডল্যান্ড-এ তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে ই-পেমেন্ট কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সব ব্যাংককে এ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা সম্ভব হবে।
ই-পেমেন্ট সম্পর্কে চেয়ারম্যান বলেন, ই-পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করে নিবন্ধিত বা তালিকাভুক্ত ব্যক্তি প্রদেয় রাজস্ব ঘরে বসে তার ব্যাংক হিসাব হতে সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা করতে পারবেন। করদাতা প্রদেয় কর পরিশোধের জন্য তার ব্যাংককে নির্দেশেনা (ইনস্ট্রাক্টশন) পাঠাবে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্রস স্টেটমেন্ট) স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের মাধ্যমে নির্ধারিত হিসাব কোডে জমা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তাৎক্ষনিক অটোমেটেড একটি চালান নম্বর জেনারেট করে এ অর্থ এনবিআরের হিসাবে জমা করবে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ জমার তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনলাইনে আইভাসে প্রেরণ করবে, যা আইভাস রক্ষিত করদাতার হিসাবে সংরক্ষিত হবে। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক এ অর্থ জমার তথ্য আইভাস প্লাস প্লাস সিস্টেমেও প্রেরণ করবে। আইভাস থেকে ই-মেইলে করদাতাকে ই-পেমেন্ট কনফারমেশন ম্যাসেজ প্রেরণ করা হবে, যা করদাতা মাসিক দাখিলপত্রে (রিটার্নে) ট্রেজারি জমার প্রমাণিক দলিল হিসেবে প্রদর্শন করবে।
ই-পেমেন্ট পদ্ধতির সুবিধা তুলে ধরে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ই-পেমেন্ট মডিউল একটি যুগান্তরকারী পদক্ষেপ যা পরিপালন খরচ কমাবে এবং ব্যবসার উন্নতি সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। প্রদেয় রাজস্ব করদাতা ঘরে বা যে কোন স্থানে বসে তার ব্যাংক হিসাব হতে সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা করতে পারবেন। নগদ অর্থ বা পে-অর্ডার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে যেতে হবে না। সহজে কর পরিশোধ করা যাবে। কর পরিশোধে সময় কম লাগবে। শতভাগ নিরাপত্তা বলয়ে কর পরিশোধ করা যাবে। এনবিআর আইভাস হতে নির্ভুল করের হিসাব পাবে। নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি থাকবে না। ট্রেজারি চালান যাচাই বিড়ম্বনা দূর হবে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আস্থার পরিবেশ তৈরি হবে।
ইএফডি কবে নাগাদ চালু হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ইএফডি স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। করোনার কারণে কিছু পিছিয়ে গেছে। করোনার কারণে বিদেশি কনসালটেন্ট ও ভেন্টরা আসতে পারেনি। আবার তারা কাজ শুরু করেছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা পাইলটিং করবো। কনসালটেন্ট এখনো আসেনি। সব রেডি আছে। আশা করি আগস্টের মধ্যে আমরা পাইলটিংয়ে যেতে পারবো। আমরা এক লাখ মেশিন দিয়ে পাইলটিং করবো। চেয়ারম্যান বলেন, ন্যাশনাল সিঙ্গেল উন্ডোজের কাজ এগিয়ে চলেছে। বন্ড অটোমেশনের কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমরা শেষ করতে চাই। আমরা আশা করছি সকল নিবন্ধিত ব্যক্তি ই-পেমেন্টের এ সুযোগ গ্রহণ করবেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন, কম্পোট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বাংলাদেশ মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুর ইসলাম, অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, অতিরিক্ত সচিব ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এ বি এম আব্দুল ফাত্তাহ, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবীর প্রমুখ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, এনবিআর সদস্য (মূসক নীতি) মো. মাসুদ সাদিক, সদস্য (মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) মো. জামাল হোসেন, সদস্য (মূসক নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা) ড. আব্দুল মান্নান শিকদার, এইচএসবিসি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব-উর-রহমান এবং ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের পরিচালক কাজী মোস্তাফিজুর রহমান।
###