ব্যাংক খাতে খেলাপির উচ্চহার

আটকে আছে আয়যোগ্য ৮৩ হাজার কোটি টাকা

শেখ আবু তালেব: খেলাপি ঋণের উচ্চহার ব্যাংক খাতে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। সময়ের সঙ্গে বড় হচ্ছে এই ক্ষত। খেলাপির উচ্চহারের কারণে ব্যাংক খাতে আটকে আছে ৮৩ হাজার কোটি টাকার বেশি আয়যোগ্য অর্থ। এটি হিসাবের খাতায় দেখাতে পারলেও মুনাফায় নেওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকাররা বলছেন, এতে কমছে ব্যাংকের নিট মুনাফা, শেয়ারপ্রতি আয় ও মূলধনের বিপরীতে আয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাত থেকে বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ছিল এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। খেলাপি হওয়া এই টাকার মধ্যে আদায় অযোগ্য বা ক্ষতিজনিত ঋণের পরিমাণ হচ্ছে এক লাখ ৪৭৩ কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না ব্যাংকাররা।

ব্যাসেল-৩ অনুযায়ী, সব ঋণের বিপরীতে মান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে। এটি ২০ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ শতভাগ পর্যন্ত রাখতে হয়। মন্দ ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের মুনাফা থেকে সমপরিমাণ অর্থ কেটে রাখতে হয়। যদিও বর্তমানে এক লাখ টাকা মন্দ মানের বিপরীতে সব ব্যাংক বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অনেকেই প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে পারেনি।

অন্যদিকে ঋণখেলাপি হওয়া শুরু করলেই এর বিপরীতে আদায়যোগ্য সুদ আলাদা হিসাবে রাখা হয়। ব্যাংকিং ভাষায় একে ইন্টারেস্ট সাসপেন্স বলা হয়। অর্থাৎ এই পরিমাণ অর্থ আদায় হওয়ার কথা থাকলেও তা ব্যাংক আদায় করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর শেষে সাসপেন্স হিসাবে অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ২৯ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ২৫ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৯ মাসের ব্যবধানে বৃদ্ধি পেয়েছে চার হাজার ২৯০ কোটি টাকা। খেলাপির তালিকায় নতুনরা যোগ হওয়ায় এই পরিমাণ সুদ আদায় হওয়ার কথা থাকলেও ব্যাংক তা পাচ্ছে না।

অন্যদিকে প্রভিশন মিলিয়ে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এর পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কারণ তুলে ধরে তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনীয় পরিমাণ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। তারা প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে। ঘাটতির তথ্য যোগ করলে পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাষ্ট্রায়ত্ত এক ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি হওয়া ঋণের ওপরও সুদ আরোপ হয়। কিন্তু সাব স্ট্যান্ডার্ড ও সন্দেহজনক মানে থাকা পর্যন্ত ঋণের সুদ সাসপেন্স হিসাবে চলে যায়। মন্দ বা আদায় অযোগ্য মানের ঋণের সুদ এই হিসাবে থাকে না। কিন্তু মামলা করার সময়ে ব্যাংক সুদ হিসাব করে গ্রাহকের কাছে পাওনা দাবি করে।

এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকারস বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণে সাসপেন্স হিসাবে যাচ্ছে আয়যোগ্য অর্থ, অথচ এটি ব্যাংকের আয়। কিন্তু আদায় না হওয়ায় তা আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো যাচ্ছে না। এতে ব্যাংকের মূলধনের বিপরীতে আয়, শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ও মুনাফা কমে যাচ্ছে। ব্যাংকের সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে।

তথ্য অনুযায়ী, সাসপেন্স হিসাবে রাখা অর্থের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। সেপ্টেম্বর শেষে অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ২৯ কোটি টাকা। প্রভিশনসহ এর পরিমাণ ৯ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। এছাড়া দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সোনালীর সাসপেন্স হিসাবে জমা হওয়া আয়যোগ্য অর্থের পরিমাণ হচ্ছে তিন হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, অগ্রণীর দুই হাজার ২৪১ কোটি টাকা, বিডিবিএল ব্যাংকের ১৩১ কোটি ৮৩ লাখ ও রূপালী ব্যাংকের পরিমাণ হচ্ছে দুই হাজার ৬৭ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের এ খাতে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ১৩ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। প্রভিশন মিলিয়ে সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা।

অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সাসপেন্স হিসাবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ হচ্ছে এবি ব্যাংকের। গত সেপ্টেম্বর শেষে এতে পরিমাণ দেখানো হয়েছে দুই হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল এক হাজার ৯৫১ কোটি টাকা। মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে প্রভিশন মিলিয়ে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা।

এছাড়া সাসপেন্স হিসাবে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকের এক হাজার ২৩৩ কোটি, ওয়ান ব্যাংকের ৫৭৩ কোটি, প্রাইম ব্যাংকের ৪৪৪ কোটি ৮১ লাখ ও ইউসিবির ৮৩৫ কোটি টাকা। এভাবে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় সাসপেন্স হিসাবে অর্থের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৬৬২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। প্রভিশন মিলিয়ে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ হচ্ছে ৪৪ হাজার ৫৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০