ইসমাইল আলী ও রোহান রাজিব: কয়েক মাস ধরেই দেশে ডলার সংকট চলছে। এজন্য এলসি খোলা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের আমদানি চাহিদা মেটাতে রিজার্ভ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ডলার সহায়তা দিয়েছে আসছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তা কমিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। রিজার্ভ ধরে রাখতে ও আইএমএফের ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সরকারের আমদানি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনতিইে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকেও নেই পর্যাপ্ত ডলার মজুত। তার ওপর রেমিট্যান্সেও সুখবর নেই। রপ্তানিতেও কয়েক মাস ধরে চলছে মন্দাভাব। ফলে আমদানি দায় মেটাতে ব্যাংকগুলোকে ডলার সংকটের মুখে পড়তে হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা বন্ধ করে দিলে সংকট আরও গভীর হবে।
এমনই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। গত ২১ ডিসেম্বর সরকারি ১৩ সংস্থার আমদানি দায় পরিশোধ ও বিদেশি ঋণের কিস্তি শোধে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকটি। ওইদিন ২৭০ দশমিক ৯৩১ মিলিয়ন ডলার দরকার ছিল ব্যাংকটির। তবে ব্যাংকটিতে ছিল না পর্যাপ্ত ডলার। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয় রাষ্ট্রায়ত্ত সর্ববৃহৎ এ ব্যাংকটির। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও কোনো সাড়া পায়নি সোনালী ব্যাংক। এতে এলসি নিষ্পত্তি ও বিদেশি ঋণ পরিশোধ আটকে গেছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার।
সোনালী ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত চিঠির প্রতিলিপি শেয়ার বিজের কাছে এসে পৌঁছেছে। এতে ১৩টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ডলার চাহিদার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০ ডিসেম্বর শেষে রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও সোয়াপ (ক্রয়-বিক্রয়) মিলিয়ে সোনালী ব্যাংকের কাছে ডলার মজুত ছিল ৫.৬৯৯ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া ব্যাংকটির নস্ট্র হিসাবে রয়েছে আরও ব্যবহারযোগ্য ৫.৪৯৩ মিলিয়ন ডলার। তবে চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ডলার সংগ্রহের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে তারা। তাই চাহিদা মেটাতে ২৭০ মিলিয়ন ডলার চাওয়া হয়েছে।
চিঠিটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২১ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংকের চাহিদার মধ্যে তিনটি ছিল পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ (সুদসহ) পরিশোধে দরকার ছিল ৪৪.১৩৫ মিলিয়ন ডলার, কয়লার ডেফার্ড এলসি নিষ্পত্তিতে চারটি বিলে ১৩৮.৭৭৬ মিলিয়ন এবং কয়লা পরিবহনের জাহাজ ভাড়া বাবদ দুটি বিলে ২.০২৩ মিলিয়ন ডলার। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের লোকেশন ট্র্যাকিং ডিভাইস বিল বাবদ ৩.১৪৬ মিলিয়ন, পাসপোর্ট অধিপ্তরের পাসপোর্ট সামগ্রীর জন্য ৫.২২ মিলিয়ন, বিসিআইসির সার আমদানির দুই বিলে ১.৬৬২ মিলিয়ন, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) নির্মাণ ব্যয় বাবদ ৭.৫৮২ মিলিয়ন ডলার দরকার ছিল।
এছাড়া ইস্টার্ন রিফাইনারির সেবাপণ্য বাবদ ৪.৩০ মিলিয়ন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একই খাতে সাত মিলিয়ন, বিপিসির জ্বালানি তেলের এলসি পেমেন্ট বাবদ ৩৪.৭৬২ মিলিয়ন, পিডিবির ঋণ পরিশোধ ১৫.২৬৪ মিলিয়ন, ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের সেবা ও শিল্পপণ্যের দুটি বিলের ০.৯৮১ মিলিয়ন, সিভিল এভিয়েশন অথরিটি রাডার স্থাপনের ব্যয় বাবদ ২.৩১৩ মিলিয়ন, প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তরের প্রতিরক্ষা সামগ্রী ক্রয় বাবদ ১.০৭১ মিলিয়ন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০০ ও ১০০০ টাকার নোট ছাপানোর কালি কেনা দুটি বিলে ২.৬৯৬ মিলিয়ন ডলার। সর্বমোট ২৭০.৯৩ মিলিয়ন ডলার চাহিদা ছিল সোনালী ব্যাংকের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২১ ও ২২ ডিসেম্বর কোনো বিল পরিশোধ বা এলসি নিষ্পত্তি করতে পারেনি সোনালী ব্যাংক। এর মধ্যে কিছু পেমেন্ট রয়েছে যেগুলো ৮-৯ বার পর্যন্ত ডেফার্ড (বিলম্বিত) করা হয়েছে। তবে আন্তঃব্যাংক লেনদেন থেকে ধার নিয়ে ২৬ ডিসেম্বর বিপিসির বিলটি নিষ্পত্তি করেছে ব্যাংকটি। যদিও ডলার চাহিদার প্রতিটি ক্ষেত্রই সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত খাত।
এ বিষয়ে জানতে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আফজাল করিম এবং উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুভাষ চন্দ্র দাসের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কল রিসিভ করেননি। পরে ম্যাসেজ দেয়া হলেও তার উত্তর দেননি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, এ ধরনের ঋণের কিস্তি বা এলসি পরিশোধের তহবিল প্রাপ্তিসাপেক্ষে সচরাচর সোনালী ব্যাংক পেমেন্ট করে থাকে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে এভাবেই চুক্তি হয়েছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট সংস্থা যদি তহবিল জোগাড় করতে না পারে, তাহলে সোনালী ব্যাংকের এককভাবে কিছু করার নেই। তবে তারা তহবিল জোগাড় করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
সোনালী ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ডলার সহায়তা দেয়া হচ্ছে না কেনÑজানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়মিত একটা প্রক্রিয়া। ডলার সমস্যা থাকলে কোনো কোনো ব্যাংক সময় বাড়িয়ে নেয়। আর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে যতটুকু সহায়তা করার দরকার করছে। এ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে রিজার্ভ থেকে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার সরকারি আমদানির দায় মেটাতে সহায়তা করা হয়েছে। এখন যেটা অতিগুরুত্বপূর্ণ সেক্ষেত্রে রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গত কয়েক দিনে সোনালী ব্যাংককে কোনো ডলার সহায়তা দেয়া হয়নি। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) এমনটি জানিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। প্রতিবেদকের সামনে তাকে মোবাইল ফোনে কল করলে ব্যাংকটির ওই কর্মকর্তা জানান, সোনালী ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়েছে, কিন্তু ইতিবাচক কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, চায়না এক্সিম ব্যাংকের ইসিএ ঋণ পরিশোধে সোনালী ব্যাংকের কাছে ডলার চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছিল। তবে তাদের কাছে পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ডেপুটি গভর্নরকে ফোন করেও অনুরোধ করা হয়। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এতে ঋণের কিস্তি পরিশোধ আটকে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলমান ডলার সংকটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পাওয়ার শর্তপূরণ হিসেবে রিজার্ভ থেকে ডলার বিচার-বিবেচনা করে ছাড়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে যে পরিমাণ ব্যাংকগুলোকে ডলার সহায়তা করা হতো তা এখন কমিয়ে আনা হয়েছে।
এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে রিজার্ভের অর্থে গঠিত অভ্যন্তরীণ ঋণ তহবিলগুলোর কার্যক্রম গুটিয়ে আনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে রিজার্ভের অর্থে গঠিত বৈদেশিক মুদ্রার গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) থেকে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের (বিআইডিএফ) কোনো প্রকল্পেও নতুন করে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) চালু থাকলেও পর্যায়ক্রমে এর আকার কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া ইডিএফের সুদের হার বাড়ানোসহ যথাসময়ে ঋণ আদায়ে জোর দেয়া হয়েছে।