সম্ভাব্য খেলাপির পদচিহ্ন

আটকে গেছে ব্যাংকের সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার সুদ

শেখ আবু তালেব: দেশের ব্যাংক খাতের বড় ক্ষত হচ্ছে পুঞ্জীভ‚ত খেলাপি ঋণ। বছর ঘুরলেই তা বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। করোনা মহামারিতে চলতি মাস পর্যন্ত নতুন করে কোনো গ্রাহককে খেলাপি না করতে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সম্ভাব্য নতুন খেলাপি কাগজে না থাকলেও জানান দেয়া শুরু করেছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব গ্রাহক ব্যাংকগুলোকে পরিশোধ করেনি ধার্যকৃত সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার সুদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এমন তথ্য। এর মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ সুদ পরিশোধ করেনি রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের গ্রাহকরা। এরপরই রয়েছে অপর রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক।

তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের আলোচিত সময়ে গ্রাহক কর্তৃক অপরিশোধিত সুদের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এটি বৃদ্ধি পেয়েছে চার হাজার ৬৮০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রমতে, ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি হঠাৎ করেই খেলাপি হয় না। প্রদেয় কিস্তির অর্থ পরিশোধে গড়িমসি শুরু করে বা দিতে ব্যর্থ হয়। এসব লক্ষণ দেখলেই ব্যাংকগুলো ধারণা করতে পারে ঋণটি খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু তখনও খেলাপি হয় না। গ্রাহকের কিস্তির বকেয়া অর্থ একটি বিশেষ হিসাবে স্থানান্তরিত করা হয় খেলাপি ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো ঋণের কিস্তি তিন মাসের বেশি কিন্তু ৯ মাসের কম সময়ে পরিশোধ না করলে তা সাব-স্ট্যান্ডার্ড, ১২ মাস কিস্তি কিস্তি না দিলে সন্দেহজনক এবং ১২ মাসের বেশি হলে ওই ঋণকে মন্দ বা খারাপ মানের ঋণ হিসেবে শ্রেণিকরণ করতে হবে। গত ২১ এপ্রিল নতুন এ সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পূর্বে তিন মাস কিস্তি না দিলেই ঋণটি সন্দেহজনক মানে শ্রেণিকরণ করা হতো।

করোনা মহামারিতে গত জানুয়ারি থেকে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত সব ঋণের মান অবনতি হওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে রেহাই দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ এ সময়ে কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তের ফলে কাগুজে হিসাবে নতুন করে কোনো খেলাপি হননি কোনো গ্রাহক। কিন্তু বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে অনেক গ্রাহকই কিস্তি পরিশোধ করছেন না। এতে এসব ঋণ সম্ভাব্য খেলাপের তালিকায় চলে গেছে।

ধার্যকৃত সুদ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলো তা একটি পৃথক বিশেষ হিসাবে রাখছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ হিসাবে ব্যাংকগুলোর জমা হওয়া সুদ ও মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৬১৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের এক হাজার ৫৭৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা, জনতার দুই হাজার ৩৬১ কোটি ৫২ লাখ, অগ্রণীর ২৭৮ কোটি ৩১ লাখ, বিডিবিএলের ৬১ কোটি, বেসিক ব্যাংকের ৫৩১ কোটি ৫১ লাখ ও রূপালী ব্যাংকের ৩১৫ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ হচ্ছে পাঁচ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এক বছরে পূর্বেও যা ছিল এক হাজার ৭৮৮ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আমিনুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কোনো ঋণের কিস্তির যতটুকু আদায় হয় না সে পরিমাণ বিশেষ হিসাবে চলে যায়। এটি ব্যাংকারদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। এসব ঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে চলে গেছে। ব্যাংকের উদ্যোগেই তখন গ্রাহকের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হয়। নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পরও যারা পরিশোধে ব্যর্থ হনÑতাদের খেলাপির তালিকায় দেখানো হয়।’

বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোয় গ্রাহক কর্তৃক অপরিশোধিত সুদের পরিমাণ হচ্ছে দুই হাজার ৩৭৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, বিদেশি ব্যাংকের মাত্র তিন কোটি ও বিশেষায়িত তিন ব্যাংকের ১০৪ কোটি টাকা। জানা গেছে, বেসরকারি খাতের মধ্যে ১১টি ব্যাংকের প্রতিটির সম্ভাব্য খেলাপিদের কাছে ইতোমধ্যে সুদ বাবদ পাওনার পরিমাণ শত কোটি টাকার পার করেছে।

সম্ভাব্য খেলাপির এ পরিমাণের বিষয়ে বেসরকারি খাতের পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরী বলেন, ‘এ অর্থ ব্যাংকের সুদ আয়। গ্রাহক পরিশোধ না করলেও ব্যাংকের হিসাব করতে হয়। করোনাকালে অনেক ব্যবসায়ী অর্থ পরিশোধ করছেন না বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া ছাড় সুবিধার কারণে। এখানে অনেকেই আছেন, যাদের খেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এজন্য গত বছরের এ সময়ের চেয়ে চলতি বছরে এ খাতে সুদের পরিমাণ অনেক বেশি। প্রকৃত তথ্য পেতে আগামী মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন বোঝা যাবে খেলাপি হওয়াদের সংখ্যা কত।’

জানা গেছে, ঝুঁকিতে থাকা এসব ঋণ আদায় হলে প্রাপ্ত সুদ আয় খাতে নিতে পারবে ব্যাংকগুলো। অন্যথায় অনাদায়ী হিসাবে স্থানান্তরিত হবে। আদায় সাপেক্ষে তা আয় খাতে দেখাতে পারবে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত মান অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নি¤œমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং কু বা আদায়-অযোগ্য ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের মুনাফা থেকে এ পরিমাণ অর্থ কেটে রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০