জয়নাল আবেদিন: নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ও এলাকার মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে ব্যাংকঋণ। বেশিরভাগ ব্যাংকেই এখন একই সমস্যা। কিছু ব্যক্তি ও এলাকায় বড় অঙ্কের ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে ব্যাংক খাত। ঝুঁকি এড়াতে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে জনতা ব্যাংকের মোট ঋণ ছিল ৬৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে আট গ্রাহকের কাছেই আছে ২০ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা বা মোট ঋণের ৩২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে উঠে এসেছে জনতা ব্যাংকের এসব ভয়াবহ তথ্য। কিন্তু গ্রাহকদের নাম প্রকাশ করা হয়নি প্রতিবেদনে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় গ্রাহক খেলাপি হয়ে পড়লে বা ঋণ আটকে গেলে আদায় করতে বেগ পেতে হয়। এজন্য ঋণ বিতরণে অধিক গ্রাহক ও এলাকা বিস্তৃত করার কোনো বিকল্প নেই।
ব্যাংকটির বর্তমান শাখার সংখ্যা ৯১৭টি। কিন্তু ঋণের বেশিরভাগই এখন কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে কয়েকটি শাখায়। মাত্র পাঁচ শাখাতেই মোট ঋণের ৭২ শতাংশ আটকে আছে বলে জানা গেছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৪৫ হাজার ৬৬২ কোটি। এসব শাখার মধ্যে রয়েছে লোকাল অফিস, জনতা ভবন করপোরেট, লালদীঘি ইস্ট, সাধারণ বীমা ও দিলকুশা করপোরেট শাখা। এই শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণকৃত এসব ঋণের মধ্যে ছয় হাজার ৬২৯ কোটি টাকাই খেলাপি হয়ে পড়েছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জনতা ব্যাংকের শীর্ষ গ্রাহকদের তালিকায় রয়েছে বহুল আলোচিত অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এক যুগ আগে নেয়া এই দুই গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু টাকাগুলো এখনও সম্পূর্ণভাবে ফেরত আসেনি। অর্থ আদায়ে মামলা চলছে অর্থ ঋণ আদালতে। এছাড়া শীর্ষ গ্রাহকের তালিকায় রয়েছেÑএস আলম রিফাইন্ড সুগার অ্যান্ড আদার, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লি., থার্মেক্স গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, বেক্সিমকো লি., রাংকা গ্রুপ, বাংলাদেশ সুগার অ্যান্ড ফুড করপোরেশন, ওরিয়ন গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ ও যমুনা গ্রুপের মতো সুপরিচিত কোম্পানি।
মামলা বিষয়ে জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ঋণ আদায়ের জন্য যাদের বিরুদ্ধে ব্যাংক মামলা করে তারা সবাই প্রভাবশালী। মামলা করলেও তারা সেই মামলা আটকাতে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করে। এর ফলে অনেক খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি আরও ভালো হতো। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে দ্রুত রিট মামলাগুলো ভ্যাকেট করার জন্য।
সার্বিক বিষয় জানার জন্য জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমডির কার্যালয়ে গিয়েও অপেক্ষা করে ফিরে আসতে হয়েছে। সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি এমডির।
যদিও সর্বশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘গত বছর ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮৬৭ কোটি টাকা কমেছে। তারপরও আমাদের ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। খেলাপি হওয়া এ ঋণের অর্ধেকের বেশি মাত্র কয়েকটি শিল্প গ্রুপের কাছে। এর মধ্যে থার্মেক্স, ক্রিসেন্ট, এননটেক্স ও আরএসআরএম গ্রুপের খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সহযোগিতা দরকার। মাত্র চারটি গ্রুপের ঋণ নিয়মিত হলে জনতা ব্যাংকের কোনো পিছুটান থাকবে না। থার্মেক্স, ক্রিসেন্ট ও এননটেক্স গ্রুপের ঋণই রয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ গ্রুপগুলোর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল হলে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অর্ধেকে নামবে। তিনটি গ্রুপেরই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে বলে ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) তুলে ধরা হয়েছে।’
এই মুহূর্তে জনতা ব্যাংকের বড় সংকট হিসেবে সঞ্চিতি ঘাটতির বিষয়টি এজিএমে উঠে এসেছে। খেলাপি ঋণ বেশি হওয়ায় বড় ধরনের সঞ্চিতি ঘাটতিতে পড়েছে জনতা ব্যাংক। ২০২০ সাল শেষে ব্যাংকের সঞ্চিতি সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ১৬ হাজার ৮৩ কোটি টাকা। একই সময়ে মাত্র ৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে পেরেছে ব্যাংকটি। এ হিসেবে জনতা ব্যাংকের সঞ্চিতি ঘাটতির পরিমাণ ১১ হাজার ৭১৬ কোটি টাকা। বিপুল এ ঘাটতি পূরণে অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জনতা ব্যাংকের এমডি এজিএমের বক্তব্যে তুলে ধরেন।