শেয়ার বিজ ডেস্ক: সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় দেশের আট জেলায় ৮২ মামলায় ৫০ হাজারের বেশি আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েক শতাধিক আসামিকে আটক করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার এড়াতে এলাকাগুলোর শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। এ জেলাগুলোর মধ্যে গাজীপুরে ৩০ মামলা মামলায় ১৫ হাজার আসামি, কুমিল্লায় তিন মামলায় ৭ হাজার আসামি, সিরাগঞ্জে ছয় মামলায় এক হাজার আসামি, গাইবান্ধায় তিন মামলায় আটশ’ আসামি, ময়মনসিংহে ১৪ মামলায় ১৪ হাজার আসামি, জামালপুরে ১০ মামলায় ১ হাজার ৩০০ আসামি, রাজশাহীতে ১৬ মামলা এবং বরিশালে ৮০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটনের আট থানায় ৩০টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় পাঁচ শতাধিক নামীয় ও অজ্ঞাতসহ ১৫ হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ নাজির আহমেদ খান জানান, ২৪ ঘণ্টায় মহানগরের থানাগুলোতে করা ৩০ মামলায় ১৮০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। নাশকতা এড়াতে আসামি গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। উপ-কমিশনার বলেন, সহিংসতার পর থেকে মামলাগুলো করা হয়। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রতিদিন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়াতে বাংলাদেশ প্রকৌশলী ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে থাকা বিভিন্ন ছাত্রাবাস থেকে শিক্ষার্থীরা চলে যাচ্ছেন।
কুমিল্লার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তিনটি মামলা করা হয়েছে। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে করা এসব মামলায় এজাহার নামীয় ও অজ্ঞাতনামা মিলিয়ে মোট ৭ হাজার ২২৯ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খাদেমুল বাহার। তিনি আরও জানান, এসব মামলায় গত বুধবার বিকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯৬ জনকে। এদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৩ জন। গ্রেপ্তারদের আদালতের মাধ্যমে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
তবে গ্রেপ্তারদের বেশির ভাগই বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী বলে জানা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষার্থীও গ্রেপ্তার হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও আসামিদের দলীয় পরিচয় নিয়ে জেলা ও থানা পুলিশের কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানার ওসি আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া বলেন, নাশকতামূলক কাজে জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আমরা আসামিকে আসামি হিসেবেই দেখছি; এক্ষেত্রে কারও দলীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় দেখা হচ্ছে না। সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় জড়িতদের ধরতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
সিরাজগঞ্জের তিনটি থানায় নাশকতা ও সহিংসতার অভিযোগে ছয়টি মামলা হয়েছে। এতে ১৩০ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামাসহ ১ হাজার ১১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ সময় মামলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী ছাড়াও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরও আসামি করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছয়টি মামলা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে হওয়া নাশতকতার মামলায় জেলাব্যাপী অভিযান চালিয়ে গত আট দিনে বিএনপি-জামায়াতের ১৫৬ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান পুলিশ সুপার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে গাইবান্ধায় পুলিশের ওপর হামলা, আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ এবং রেলওয়ে স্টেশন ভাঙচুরের ঘটনায় আলাদা তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলায় সাত দিনে বিএনপি, জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের ৮২ নেতাকর্মীকে আটকের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কোটা সংস্কারের দাবি ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ১৭ জুলাই সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। একপর্যায়ে তারা শহরের ১ নম্বর রেলগেটে অবস্থান নেয়। সেই সময় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। একই দিনে ওই বিক্ষোভ থেকে গাইবান্ধা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা ও মোটরসাইকেলে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশের ওপর হামলা, অগ্নিসংযোগ, নাশকতা এবং সরকারি স্থাপনা ভাঙচুরের ঘটনায় ময়মনসিংহে ১৪টি মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার জনকে। এর মধ্যে গত বুধবার সকাল ১০টা থেকে আগের ২৪ ঘণ্টায় ২৪ জনসহ মোট ১২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) শামীম হোসেন।
তিনি বলেন, ময়মনসিংহ সদর, গৌরীপুর এবং ফুলপুরসহ বিভিন্ন থানায় ১৮ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত এসব মামলা করা হয়। মামলাগুলোর বেশির ভাগ আসামি অজ্ঞাত পরিচয়ের। বাকিদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে পুলিশ। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে জেলায় পাঁচজন নিহত এবং ৭০ জনের মতো আহত হয়েছেন। তবে নিহত এবং আহত পরিবারের মধ্যে কেউই থানায় অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছেন পুলিশ।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজশাহীতে সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হাতবোমা বিস্ফোরণ ও পুলিশের কাজে বাধার ঘটনায় ১৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বুধবার ভোর পর্যন্ত ২১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া সেলের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জামিরুল ইসলাম এবং জেলা পুলিশের মিডিয়া সেলের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম।
জামিরুল ইসলাম জানান, রাজশাহী নগরীর তিনটি থানায় সাতটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বোয়ালিয়া থানায় চারটি, মতিহার থানায় দুটি ও চন্দ্রিমা থানায় একটি। তিনি বলেন, এ নিয়ে রাজশাহী মহানগরীর নাশকতার সাত মামলায় মোট ১০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হল। এর মধ্যে বুধবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১২টি থানায় মোট ৩৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে জেলা পুলিশের মিডিয়া সেলের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম জানান, পুলিশের ওপর হামলা, সরকারি কাজে বাধা, হাতবোমার বিস্ফোরণ, আগুন জ্বালিয়ে মহাসড়ক অবরোধ ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় জেলার আট থানায় ৯টি মামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এসব মামলায় বুধবার ভোর পর্যন্ত ১০৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে বুধবার ভোর ৬টা থেকে গত ২৪ ঘণ্টায় ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারদের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী রয়েছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপি এবং তার সহযোগী সংগঠনের ৮০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত বুধবার কোতোয়ালি মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমানুল্লাহ আল বারী জানান, গত মঙ্গলবার রাতে মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার রাজীব বাদী হয়ে এ মামলা করেন। তিনি বলেন, মামলায় মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক, সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদারসহ ২৭ জন নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৮০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় এখনও কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। পরির্দশক বারী বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্যসহ বেআইনি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে দাঙ্গা সৃষ্টি করতে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি এবং মারধর করে গুরুতর ও সাধারণ জখম এবং বোমা বিস্ফোরণের অভিযোগ আনা হয়েছে।
জামালপুরে পুলিশের ওপর হামলা ও নাশকতার ১০ মামলায় জামালপুরে বিএনপি-জামায়াতের ১ হাজার ৩০০ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জামালপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) মো. সোহেল মাহমুদ জানান, সাম্প্রতিক সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় জামালপুর সদরে চারটি এবং অপর ছয়টি থানায় একটি করে আলাদা মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এসব মামলা সম্পূর্ণ অসত্য বলেও দাবি করেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। জামালপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওয়ারেছ আলী মামুন বলেন, ‘ছাত্রদের আন্দোলন ছাত্ররা করেছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপিকে ঘায়েল করতে এসব মামলা করা হয়েছে।’
জামালপুর জেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেন, এসব মামলা মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও সাজানো। বিরোধী দলকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে এসব গায়েবি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলা করে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বিতর্কিত হচ্ছে।