আট প্রতিষ্ঠানেই মোট খেলাপি ঋণের ৭৪ শতাংশ

জয়নাল আবেদিন: হাতেগোনা কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ভালো অবস্থানে থাকলেও অধিকাংশের অবস্থা নাজুক। এসব প্রতিষ্ঠানের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৯ শতাংশই এখন খেলাপি। এ খেলাপির বেশিরভাগই মাত্র আট প্রতিষ্ঠানে। এনবিএফআই খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৭৪ শতাংশই এ আট প্রতিষ্ঠানে। এছাড়া নতুন করে টান পড়েছে আর্থিক খাতের আমানতে, যা খাতটির জন্য সুখকর নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

গত কয়েক বছরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কেলেঙ্কারি ছিল আলোচিত ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো, যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে বিতরণকৃত ঋণের টাকা ফেরত আসছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব বলছে, ২০২১ শেষে মাত্র আট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপির পরিমাণ ৯ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। এই আট প্রতিষ্ঠানের খেলাপি আর্থিক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৭৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে এনবিএফআইগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ৬৭ হাজার ৩৫৪ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ১৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। অন্যদিকে পাঁচ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রভিশন ঘাটতি ছাড়িয়েছে এক হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে যেসব প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম আভিভা ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটির বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ৬৯৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা, যা তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৬ শতাংশ। এছাড়া বিআইএফসির খেলাপি ৭৬০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯৬ শতাংশ। ফারইস্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৮৭১ কোটি ৭২ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণের ৯০ শতাংশ। ফাস ফাইন্যান্সের খেলাপি এক হাজার ৭১৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণের ৮৯ শতাংশ। ফার্স্ট ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৪১ কোটি ৭২ লাখ, যা মোট বিতরণের ৮৩ শতাংশ। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি তিন হাজার ২১০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণের ৭৯ শতাংশ। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের মোট খেলাপি ৬১৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণের ৪৬ শতাংশ এবং উত্তরা ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৯৯৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা মোট বিতরণের ৪২ শতাংশ।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) ভাইস চেয়ারম্যান ও আইআইডিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া বলেন, করোনাকালে খেলাপি ঋণের বিষয়ে সরকার যে সুবিধা দিয়েছিল, তা তুলে নেয়ার কারণেই মূলত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের ঋণখেলাপি বেড়েছে। তাছাড়া ২০২১ সালে কিস্তির ১৫ শতাংশ দিতে হয়েছে গ্রাহককে। যারা দিতে পারেনি তারা খেলাপি হয়ে পড়েছেন। চলতি বছরে বিশেষ সুবিধাগুলো পুরোপুরি উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। মার্চ বা জুনে খেলাপি আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে, যেটা আগে আরও কম ছিল। এর কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্বিক আমানতে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকের ঋণের হার বেঁধে দেয়ার কারণে এমনিতেই আর্থিক খাতের বিনিয়োগের সুদহার কমে গেছে। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ও ঋণের সুদ নির্ধারণ করে দিলে কেমন প্রভাব পড়তে পারে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমানতকারীরা কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করেছেন। তারা বলছেন, সময়মতো আমানত ফেরত দিতে পারছেন না তারা। ফলে নতুন করে অনেকে এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। সাধারণ আমানতকারীদের পাশাপাশি বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক কিংবা বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এসব প্রতিষ্ঠানে আগের মতো আর টাকা রাখছে না। আবার নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণও সময়মতো ফেরত আসছে না, যে কারণে উচ্চ সুদের অফার করেও আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।’

বর্তমানে দেশে চারটি সরকারি ও ৩০টি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঋণের নামে প্রচুর অর্থ বের করার ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে এ খাতের আর্থিক ভিত অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে খাত-সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগের পর এ খাতের অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে। এর কিছুদিনের মধ্যে আবার এনআরবি গ্লোবাল ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সামনে আসে। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বিআইএফসিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেন আদালত। অত্যন্ত নাজুক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করে বিশেষ তদারকিতে রেখেছে। সম্প্রতি ফার্স্ট ফাইন্যান্সের এএমডি তুহিন রেজাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আমানত সংগ্রহে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চাকরিচ্যুত করা হয় তাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষ করে মন্দ ঋণ এ খাতের পরিস্থিতিকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে এটি গত এক দশকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। সব মিলিয়ে বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন টাকার সংকটে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে ক্রমেই এ খাতের প্রতি আস্থা কমায় আমানত কমছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০